বিশ্বব্যাপী পুরুষের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় সেটা হচ্ছে প্রোস্টেট ক্যান্সার। সাধারণত যেসব পুরুষের বয়স ষাটের উপরে তারাই বেশি প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। আফ্রিকান আমেরিকান, এশিয়ান আমেরিকান, মধ্য আমেরিকানদের মধ্যেই প্রোস্টেট ক্যান্সারের প্রবণতা বেশি বলা হয়, কিন্তু বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত প্রোস্টেট ক্যান্সারের প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
আসুন জেনে নেয়া যাক প্রোস্টেট ক্যান্সার কি ?
পুরুষের মূত্রথলির নিচে মূত্রনালীর চারিদিকে বাদাম আকৃতির একটি গ্রন্থি থাকে এই গ্রন্থিকে বলা হয় প্রোস্টেট গ্রন্থি এবং এই গ্রন্থিতে ক্যান্সার হলে সেটাকে প্রোস্টেট ক্যান্সার বলা হয়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুরুষের প্রোস্টেট গ্রন্থির আকার বাড়তে থাকে এবং প্রসাবে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের সমস্যাকে বয়সজনিত, সাধারণ প্রোস্টেট বৃদ্ধিজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় কিন্তুু কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা নিয়ে প্রোস্টেট ক্যান্সারও প্রকাশ পেতে পারে। এজন্যই বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতিটি পুরুষের নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হয় কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রোস্টেট ক্যান্সারের কোন লক্ষণ থাকে না।
আসুন আমরা জেনে নিই প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকিসমূহ কি কি ?
প্রতিটি পুরুষই যেহেতু শরীরে টেস্টোস্টেরন নামক পুরুষ হরমোন বহন করেন তাই বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুরুষের প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকে। অর্থাৎ কোন পুরুষই প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকিমুক্ত নয় অন্যান্য ঝুঁকির কারণ গুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
জিনগত পরিবর্তন : কিছুক্ষেত্রে যেমন:- HPC1 I BRCA 1, ২ জীন মিউটেশন যাদের মধ্যে রয়েছে তারা প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
বয়স : সাধারণত দেখা যায় ৪০ বছরের কম বয়সে প্রোস্টেট ক্যান্সার হয় না বললেই চলে তবে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে প্রোস্টেট ক্যান্সার বেশি দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৬০% রোগীর বয়সী ৬৫ বছরের উপরে।
পারিবারিক ইতিহাস : যাদের পরিবারে ভাই, বাবা, চাচা, দাদা কেউ একজন প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন সেসব পুরুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় নয় গুণ বেশি।
হরমোন জনিত কারণ : যাদের মধ্যে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বেশি বা ও GF1 বেশি আছে তারা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন ।
এছাড়াও কিছু কারণ রয়েছে যেমন : স্থুলতা, যৌনবাহিত রোগ, যারা শারীরিক পরিশ্রম কম করেন, ধূমপান করেন, যারা তেল চর্বি মসলা জাতীয় খাবার, লাল মাংস ইত্যাদি বেশি খান এবং সবুজ সতেজ শাক-সবজি কম খান তাদের মধ্যেও প্রোস্টেট ক্যান্সারের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
প্রোস্টেট ক্যান্সারের লক্ষণ সমূহ কি কি ?
প্রাথমিক অবস্থায়ঃ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো লক্ষণ থাকেনা।
স্থানীয়ভাবে বিস্তৃত অবস্থায় : যে সকল লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে:-
* ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া।
* প্রসাব হওয়ার পরও মনে হবে ক্লিয়ার হয়নি।
* থেমে থেমে প্রস্রাব হওয়া।
ফোটায় ফোটায় প্রসাব ঝরা।
* প্রসাবের সাথে রক্ত বা শুক্রাণু যাওয়া।
* প্রসাব লাগলে আটকে রাখতে না পারা।
* প্রসাবে ইনফেকশন হওয়া।
অগ্রবর্তী অবস্থায় যে সকল লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারেঃ
* পিঠের পিছনে মেরুদন্ডের নিচের দিকে ব্যথা হওয়া।
* দুই কুচকি ফুলে ওঠা।
* দুই পা ফুলে যাওয়া।
* স্পাইনাল কর্ডে চাপ দেয়া সেক্ষেত্রে দুই পায়ে বোধশক্তি কমে যাওয়া ও প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া।
আসুন জেনে নেয়া যাক প্রোস্টেট ক্যান্সার শনাক্তকরণের পদ্ধতি কি কি ?
যারা প্রোস্টেট ক্যান্সারের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন বা উপরোক্ত লক্ষণ সমূহের মধ্যে কোন একটা বিদ্যমান রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে শারীরিক পরীক্ষা, ডিজিটাল রেক্টাল এক্সামিনেশন ও PSA পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা ধারণা করতে পারি তার প্রোস্টেট ক্যান্সার থাকতে পারে কিনা। এরপর নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা বায়োপসি পরীক্ষা করি।
এরপর কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা হয় শরীরের মধ্যে এর বিস্তৃতি কতদূর হয়েছে। বেশিরভাগ প্রোস্টেট ক্যান্সারই দেখা যায় মেরুদন্ডের হাড়ের মধ্যে ছড়ানো অবস্থায় আমাদের কাছে আসে। তখন আমাদের ক্যান্সারের চিকিৎসার পাশাপাশি হাড়ের চিকিৎসা করাও জরুরি হয়ে পড়ে। নতুবা হাড়ে তীব্র ব্যথা এমনকি হাড় ভেঙেও যেতে পারে।
চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ জটিল। কিন্তু সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসা নিলে একজন প্রোস্টেট ক্যান্সার রোগী দীর্ঘদিন ভালো থাকতে পারেন।
চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো হলো:
১. হরমোনথেরাপী ।
২. কেমোথেরাপী ।
৩. রেডিওথেরাপী ও
৪. সার্জারী।
অতএব আসুন নিজে সচেতন হই, পরিবার ও সমাজকে সচেতন করি।
আমার, আপনার “সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দূর হোক ক্যান্সার চিকিৎসার সকল অন্তরায়”।
ডাঃ মোঃ তৌছিফুর রহমান
এম.বি.বি.এস (শসোমেক), সি.সি.ডি(বারডেম), এম.ডি(অনকোলজি) বিএসএমএমইউ ।
সহকারী অধ্যাপক (ক্যান্সার রোগ বিশেষজ্ঞ)
টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও ক্যান্সার সেন্টার, বগুড়া।
চেম্বার: ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক ও কনসাল্টেসন সেন্টার, বগুড়া