‘ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?’
— শামসুর রাহমান
প্রথিতযশা কবি শামসুর রাহমানের বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয় নিয়ে রচিত নানা কবিতা এবং ছড়ার মধ্যে ‘ট্রেন’ নিয়ে লেখা এই ছড়াটি শৈশবে আমাদের অনেকেরই পছন্দের ছিল। গতিময়তা, দূরদূরান্তে গমন, রাতদিন বিরামহীন ছুটে চলা, বিপুল পরিমাণ যাত্রী ও পণ্য বহনের সক্ষমতা ইত্যাদি নানা কারণে দেশে-বিদেশে বাহন হিসাবে ট্রেনের গ্রহণযোগ্যতা সর্বজনবিদিত। আমাদের শৈশবের প্রথম রেলভ্রমণ—ঝক ঝক ঝক—ট্রেনের অদ্ভুত ছন্দময় ছুটে চলা মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছে এখনো। বড় হতে হতে সরকারি কাজে, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কিংবা বিনোদনহেতু দেশে ও দেশের বাইরে আমাদের বেশ অনেকবারই ট্রেনে ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর অত্যাধুনিক হাই স্পিড ট্রেন ও রেললাইন ব্যবস্থাপনা দেখে মনে মনে ভেবেছি, ইস্ আমাদের দেশেও যদি এমনটা থাকত!
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প (পিবিআরএলপি) এমনই একটা স্বপ্ন পূরণেরই মাধ্যম। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক রেল মন্ত্রণালয় গঠনের মধ্য দিয়ে অবহেলিত রেল যোগাযোগব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর এক মহতী উদ্যোগ নিয়েছেন বিগত ২০১১ সালে। এরই অংশ হিসাবে আধুনিক রেলসংযোগের বিস্তৃতি বাড়িয়ে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প। এ প্রকল্পটি আর্থিক বিবেচনায় (৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা) সরকারের সর্ববৃহৎ প্রকল্পগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কনসট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্টের (সিএসসি) তত্ত্বাবধানে স্বনামধন্য চাইনিজ ঠিকাদার কোম্পানি চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের (সিআরইসি) মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়িত্ব ও গুণমান বজায় রেখে এই প্রকল্পটি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলেছে।
গত ১৪ অক্টোবর ২০১৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা-উত্তর রেল মন্ত্রণালয়ের সর্ববৃহৎ এই প্রকল্পকাজের আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন করেন এবং সব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এ সুবিশাল কর্মকাণ্ড মাঠ পর্যায়ে শুরু হয় জানুয়ারি ২০১৯-এ। প্রকল্পটির আওতাধীন রয়েছে ২৩ দশমিক ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ভায়াডাক্ট বা উড়াল রেল সেতু, ৫৯টি বড় দৈর্ঘ্যের সেতু, ১৪২টি কালভার্ট ও ১৩৫টি আন্ডারপাস। জনগণের যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে এই প্রকল্পে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত ১৬টি নতুন স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে এবং চারটি পুরোনো স্টেশনের সংস্কার কার্যক্রমও চলমান আছে।
প্রকল্পটিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চারটি জেলা মুন্সীগঞ্জ, শরিয়তপুর, নড়াইল ও মাদারীপুরকে নতুন করে সরাসরি রেলসংযোগের আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি ভবিষ্যতে বরিশাল ও পায়রা বন্দরকেও সংযুক্ত করার ব্যবস্থা রয়েছে। সর্বোপরি বাস্তবায়ন শেষে এই রেলব্যবস্থা হবে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রেললাইন পরিচালনায় থাকছে অত্যাধুনিক কম্পিউটার বেস্ড রিলে ইন্টারলক্ড সিগন্যালিং সিস্টেম, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে দ্রুতগতির পরিবেশ বান্ধব ইলেকট্রিক রেললাইন তৈরির সব সুযোগও উন্মুক্ত থাকছে।
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের অসংখ্য স্ট্রাকচারের মধ্যে বেশ কিছু রয়েছে স্টিল ট্রাস স্ট্রাকচার; মূলত বড় বড় সেতু এ কৌশলে নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ধরনের স্টিল ট্রাস (steel truss) স্ট্রাকচারের মূল অংশগুলো নকশা ও মাপ অনুযায়ী সুদূর চীনে তৈরি করা হয় এবং সেখান থেকে সমুদ্রগামী জাহাজে দেশে নিয়ে আসা হয়। পাশাপাশি এগুলো স্থাপনের নানাবিধ সরঞ্জাম, যেমন উঁচু ক্রেন, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ড্রিলিং রিগ, গার্ডার ট্রাক ইত্যাদিও চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা হয়েছে। সবই যদি চীন থেকে আনতে হয়, তাহলে বাংলাদেশ থেকে কি কোনো কিছুই এ প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে না? ব্যাপারটি তা নয়; এতে দেশীয় রড, সিমেন্ট, বালি, নুড়িপাথর, অ্যাডমিক্সার ইত্যাদি নানাবিধ নির্মাণসামগ্রী যেমন ব্যাপকহারে ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে, তেমনি প্রায় ৫ হাজার দেশীয় নির্মাণশ্রমিক ও প্রকৌশলী এই কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জীবনজীবিকা নির্বাহ করতে পারছে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প ও পদ্মা সেতুর সবচাইতে দৃষ্টিনন্দন অংশ হচ্ছে পদ্মা নদীর ঠিক দুই পাড়ের রেল ও সেতুর সংযোগস্থল। অনেক হিসাবনিকাশ ও কারিগরি বিষয় মাথায় রেখে এই দুই সংযোগ অংশের নকশা প্রণয়ন এবং পরবর্তী সময়ে তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পদ্মা নদীর মাওয়া প্রান্তে উড়াল রেল সেতুর (ভায়াডাক্ট-২) ওপরে উটের কুজের মতো নীল রঙের একটি নান্দনিক স্টিল ট্রাস সেতু দৃশ্যমান হয়। মরুভূমির জাহাজ উটকে যেমন তার কুজ বিনা আমরা চিন্তা করতে পারি না, তেমনি ইস্পাতনির্মিত এই সেতু ছাড়া নৈসর্গিক ও ভুবন ভোলানো পদ্মা সেতু ও রেললাইনের সৌন্দর্যেও যেন ঘাটতি রয়ে যেত।
২ দশমিক ৫৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল রেল সেতু-২-এর নকশাতে সর্বমোট ৬৮টি স্প্যান ছিল; এর মধ্যে গত জুলাই ২০২০-এ ৬৫টি স্প্যান নির্মাণ ও স্থাপন শেষ হওয়ার পর মাওয়া থেকে পদ্মা সেতুতে আগমনের মূল রাস্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে নকশায় কিছু পরিবর্তন ও পরিমার্জন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। উড়াল রেল সেতুর বক্রতার (curved design) কারণে এবং পিয়ার নম্বর ১৪ ও ১৫-এর নিচে বিদ্যমান আগমনের মূল রাস্তার অনুভূমিক (Horizontal) ক্লিয়ারেন্স ১৫ দশমিক ৫ মিটারের চেয়ে কম হওয়াতে সেতুমুখী আগত দ্রুতগতির যানবাহন পিয়ারের সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনার বিষয়টি ভীষণ চিন্তায় ফেলে দেয় সবাইকে।
উড়াল রেল সেতুর (ভায়াডাক্ট-২) একেকটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ছিল ৩৮ মিটার করে; বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞ প্রকৌশলীগণ কর্তৃক অনেক আলোচনা ও পর্যালোচনা শেষে পিয়ার নম্বর ১৩ থেকে ১৬ পর্যন্ত তিনটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন করে ১৬ দশমিক ১৪ মিটার করে দুই পাশে দুটি প্রিসট্রেস্ড গার্ডার এবং পিয়ার নম্বর ১৪ ও ১৫-এর মধ্যে ৮১ দশমিক ৭২ মিটার দৈর্ঘ্যের স্টিল ট্রাস সেতু তৈরির নকশা চূড়ান্ত অনুমোদনের মাধ্যমে বেশ চ্যালেঞ্জিং এই সমস্যা নিরসনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর এবার আসে তা কার্যকারিতায় পরিণত করা। স্টিল ট্রাস সেতুর নকশা সম্পন্ন হওয়ার পর তা চীনের ফ্যাক্টরিতে পাঠানো হয় এবং স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ক্ষুদ্র নাট-বোলট থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় দৈর্ঘ্যের স্টিল ট্রাস তৈরিতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।
গুণমান বজায় রেখে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এ ধরনের বিশেষায়িত ও চ্যালেঞ্জিং কাজ সম্পন্ন করার অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া এই প্রায় অসাধ্য কাজটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ রেলওয়ে, দেশি-বিদেশি পরামর্শক ও চীনের অতীব দক্ষ প্রকৌশলীগণের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে এপ্রিল ২০২২-এর মধ্যেই সমাপ্ত করা হয়। এ যেন কার্যদক্ষতা, বিচক্ষণতা ও পেশাদারিত্বের এক নতুন মাইলফলক।
আড়িয়াল খাঁ রেল সেতু
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলোর কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে ১৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩০০ মিটার প্রশস্ত আড়িয়াল খাঁ নদী। এ নদীর ওপর নির্মিত ৬০৯ মিটার লম্বা স্টিল ট্রাস সেতুটি এই রেল প্রকল্পের অন্যতম বৃহৎ সেতু। ছয়টি ১০১ দশমিক ৫ মিটার দীর্ঘ স্টিল ট্রাস গার্ডার স্প্যান, ৪৮টি ৭০ মিটার দীর্ঘ ও দুই মিটার ব্যাসের বোরড পাইল, পাঁচটি পিয়ার এবং দুটি মজবুত এবাটমেন্টের ওপর ভিত্তি করে এ সেতুর নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। অক্টোবর ২০১৯-এ শুরু হওয়া এই স্টিল ট্রাস সেতু নির্মাণের সময়ে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা এসেছে। দুটি পিয়ার ড্রিলিং করার সময় পাইলের গর্তের ভেতর ১৫ মিটার গভীরতায় কঠিন শিলাস্তরে ড্রিলিং বাধাগ্রস্ত হয় এবং এই শিলাস্তর ভেদ করে কিছুতেই কাজ অগ্রসর করানো যাচ্ছিল না। পরবর্তীসময়ে চীন থেকে ৫ হাজার কেজি ওজনের বাকেট বিট হ্যামার নিয়ে এসে এই শিলাস্তর ভেদ করে এই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করা হয়।
বুড়িগঙ্গা রেল সেতু
রাজধানী ঢাকাকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ঘিরে থাকা ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩০২ মিটার প্রশস্ত বুড়িগঙ্গা অবস্থানের কারণেই দেশের অন্যতম প্রধান নদী হিসেবে পরিগণিত হয়। এ নদীর ওপর নির্মীয়মাণ স্টিল ট্রাস সেতুটি ৪০৬ মিটার দীর্ঘ। সেতুটি ১০১ দশমিক ৫ মিটার লম্বা চারটি স্টিল ট্রাস গার্ডার স্প্যান দ্বারা নির্মিত হচ্ছে, যাতে রয়েছে ৬৫ মিটার থেকে ৮৫ মিটার দীর্ঘ ৪৮টি বোরড পাইল, তিনটি পিয়ার ও দুটি এবাটমেন্ট। এ স্টিল ট্রাস সেতুর নির্মাণকাজ ২২ মার্চ ২০২০ থেকে শুরু হয়। এ সেতুর দুটি পিয়ার নদীর মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় দুর্ঘটনাবিহীন নৌযান চলাচল নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে শীতের সময়ে রাত্রিকালীন কুয়াশার জন্য বিশেষ সতর্কতা গ্রহণ করা হয়। বিআইডব্লিটিএর সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক সেতুটির উজান ও ভাটিতে ৫০০ মিটার এলাকায় নিরাপদ নেভিগেশনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বয়া স্থাপন ও দুটি নেভিগেশন বোট স্থাপনের মাধ্যমে সব নৌযানকে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পটি আমাদের কাছে এক স্বপ্নের সারথি। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ও ১ শতাংশ জিডিপি বর্ধিতকরণের স্বপ্ন নিয়ে এই বিস্ময়কর ও মেগা রেলব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল ২০১৯ সালের শুরুতে। অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন, এই রেললাইন তৈরিতে এত সময় কেন লাগছে? আমরা কি যথাসময়ে কাজ শেষ করতে পারব? এক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করব।
প্রথমত রেললাইন নির্মাণের সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি ভূমির অনেক গভীর থেকে শুরু হয়ে স্তরে স্তরে শেষ করতে হয়। ট্রেনের অত্যধিক এক্সেল লোডের কারণে ভূমির যে কোনো দুর্বলতা সম্পূর্ণ তিরোহিত।
Array