চিলির মূল দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ ইস্টার আইল্যান্ড। জনমানবহীন দ্বীপটি বিখ্যাত ‘‘মোয়াই’’ মূর্তির জন্য। প্রশস্ত নাক, বড় চিবুক ও আয়ত ক্ষেত্রাকার আকৃতির কানের অদ্ভুত দৈত্যকার এমন প্রায় এক হাজার মূর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দ্বীপটিতে। এসব যেনো পুরো দ্বীপের পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ মূর্তি নিয়ে রয়েছে চমকপ্রদ পৌরাণিক কাহিনি।
ধারণা করা হয়, ৪০০ থেকে ১২৫০ সালের নাগাদ বা এই সময়ের কোনো এক অংশে রাপা নুই জাতি পলিনেশিয়ার মারকুসেস দ্বীপ থেকে ইস্টার দ্বীপে এসে বসতি স্থাপন করেন। দুটি দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ২,২০০ মাইল তথা প্রায় ৩,৬০০ কিলোমিটার। ফলে এই দূরত্ব কীভাবে পাড় করলেন তারা সেটা এখনও এক রহস্য।
আমেরিকার এই আদি পলিনেশিয়ান জাতি রাপা নুই আদিবাসীদের হাত ধরেই সৃষ্টি হয় অদ্ভুত সব ‘‘মোয়াই’’ মূর্তি।
রাপা নুই জাতির সংস্কৃতি কিছু পলিনেশিয় জাতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ করে ঐতিহ্যগত পালক লাগানো পাগড়ি এবং ধুতির পোশাক। আর গয়না ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র তৈরি হয় পাথর, কাঠ, ঝিনুক ও প্রবালের।
স্থানীয়দের মধ্যে প্রচলন রয়েছে, হোতু মাতু নামে এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম ডিঙি নৌকায় চড়ে এই দ্বীপে তার স্ত্রী ও কিছু সাথী নিয়ে আসেন। যদিও এই তথ্যের বিশ্বাসযোগ্য সূত্র নেই।
‘‘মোয়াই’’ মূর্তি তৈরির বিষয়ে জানা যায়, আনুমানিক ১২৫০ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে অর্থাৎ প্রায় ৯০০ বছর আগে এই মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছিল। পুরো দ্বীপে প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি মূর্তি রয়েছে।
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত দ্বীপটির মূর্তি সম্পর্কে জানা যায়, সংকুচিত আগ্নেয়শিলার আস্ত শিলা খোদাই করে এসব আবক্ষ মূর্তি তৈরি করা হয়েছে।
এসব মূর্তিগুলো বৃহৎ আকারের। এগুলোর প্রশস্ত নাক, বড় চিবুক আর কানের আকৃতি আয়তক্ষেত্রাকার। এর শুধু মাথা ও মুখই বাইরে বের করা।
রাপা নুইদেরই পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতি বলে মনে করা এসব মূর্তির প্রায় তিন-অষ্টম অংশ জুড়ে মাথা। মাথা এতো বড় হওয়ার কারণ হিসেবে ধারণা করা হয় প্রাচীন বিশ্বাস।
একেকটির উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট (১২ মিটার) ও ওজন ১৪ টনের কাছাকাছি। এসব মূর্তি নির্মাণের পর স্থাপন করা হয়েছিল ‘‘আহু’’ নামের পাথরের ওপর।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, মূর্তিগুলো প্রাচীন পলিনেশিয়ানদের পূর্ব পুরুষদের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। ‘‘মোয়াই’’য়ের মূর্তিগুলো সমুদ্র থেকে দূরে ও গ্রামের দিকে মুখ করে যেন মানুষের নজর রাখছে। তবে সমুদ্রের দিকে মুখ থাকার নজিরও আছে। সমুদ্রের দিকে মুখ থাকা মূর্তিগুলো ভ্রমণকারীদের দ্বীপটি সন্ধান করতে সাহায্যের জন্য রাখা হয়েছিল।
জনশ্রুতি আছে যে, সেখানে সাতজন পুরুষ ছিল যারা তাদের রাজার আগমনের জন্য অপেক্ষা করেছিল।
তবে দীর্ঘ পুরনো এসব মূর্তি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। ছত্রাক শৈবালের আক্রমণে ধসে যাচ্ছে মুখের অংশ। দীর্ঘদিন ধরেই নিয়ম করে এসব মোয়াই স্পর্শ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
চিলির স্যান্টিয়েগো থেকে প্রতিদিন একটি ফ্লাইটে করে এই দ্বীপে যাওয়া যায়। এখানে বেড়ানোর উপযুক্ত সময় জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস। শীতকালে অতিরিক্ত শীত পড়লেও বাকি সময় তাপমাত্রা থাকে ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে সর্বনিম্ন ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রহস্যজনক ইতিহাসের কাছাকাছি ঘুরে আসতে তাই পর্যটকদের অন্যতম পছন্দ এই বোবা মূর্তি দর্শন।
Array