অনলাইন ডেস্ক:
প্রিজাইডিং অফিসারদের দুই ধরনের বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক বন্ধ ঘোষিত গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিজাইডিং অফিসাররা নির্বাচন নিয়ে দুই ধরণের লিখিত বয়ান দিয়েছেন।
এই পরস্পরবিরোধী বয়ান নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন বিতর্ক। যে ৫১ জন নির্বাচন কমিশনে নির্বাচন বন্ধ করার কারণ সম্বলিত চিঠি দিয়েছেন তারাসহ সকল প্রিজাইডিং অফিসার উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে দেওয়া বয়ানে, ভোট সুষ্ঠুভাবে চলছিলো উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে বন্ধ করা হয়েছে বলে বর্ণনা দিয়েছেন। অথচ এরাই নির্বাচন কমিশনে দেওয়া চিঠিতে বলেছেন, সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় ভোট বন্ধ করা হয়েছে। ইসিতে পাঠানো চিঠি গোপন থাকলেও ইউএনওকে দেওয়া প্রিজাইডিং অফিসারদের চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকা প্রিজাইডিং অফিসাররা (যারা সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী) দুই ধরণের বক্তব্য দিয়ে কমিশনের প্রতি অবাধ্যতা প্রকাশ করেছেন। যা সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা বিধিমালা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক এক সচিব। এটা তারা কোনক্রমেই করতে পারেন না। কমিশন এখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে চিঠি দিতে পারে। সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয়গুলো ব্যবস্থা নিতে বাধ্য।
গত বুধবার ব্যাপক অনিয়মের কারণে গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করে ইসি। ওই নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ছিলো ১৪৫টি। সবগুলো কেন্দ্রের বুথে ১ হাজার ২৪২টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল; ঢাকার নির্বাচন ভবনে স্থাপিত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হয় কেন্দ্রের পরিস্থিতি। ভোটের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার নির্বাচন বন্ধ করে ইসি। ভোটবন্ধের আগে ৫১টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়। ওই কেন্দ্রগুলোর প্রিজাইডিং অফিসাররা নির্বাচন কমিশনে পাঠানো স্থগিত চিঠিতে ভোটের পরিবেশ না থাকায় ভোটবন্ধের কথা উল্লেখ করেন। এই সিদ্ধান্ত ক্ষুব্ধ হয় আওয়ামী লীগ। ১৪৫টি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারদের ভোটের পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে বলা হয় স্থানীয় প্রশাসন থেকে। পরবর্তীতে সেই মোতাবেক স্থানীয় নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বরাবর লিখিত বক্তব্য দেন প্রিজাইডিং অফিসাররা। স্থানীয় প্রশাসনের চাপে পড়ে প্রিজাইডিং অফিসাররা ‘ভোট সুষ্ঠুভাবে চলছিলো’ ‘কোন বিশৃঙ্খলা হয়নি’ বলে উল্লেখ করেন চিঠিতে।
এর মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, সাঘাটার ৮৮টি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসাদের একপ্রকার লিখিত বক্তব্য দিতে বাধ্য করেছেন ওই উপজেলার ইউএনও নিজেই। সাঘাটার জুমারবাড়ি আদর্শ ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক একে এম জুলফিকার হায়দার নলছিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রিজাইডিং অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ‘নির্বাচনী কর্মকর্তা সহকারী রিটার্নিং অফিসার মো. কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় আমি একে এম জুলফিকার হায়দার প্রিজাইডিং অফিসার হিসাবে নলছিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটগ্রহণ বন্ধ করলাম। ভোটসুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে একে এম জুলফিকার হায়দার বলেন, সাঘাটা ইউএনও অফিস থেকে ভোটের পরিস্থিতি কেমন জানতে চেয়ে লিখিত দিতে বলেন। আমরা সেই মোতাবেক লিখিত দিয়েছি। তবে চিঠিতে কাউকে মেনশন করতে বলা হয়নি।
একইভাবে সাঘাটার বারকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন বিঞ্চু পদ সিংহ। তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসাবে সাঘাটা ডিগ্রি কলেজে কর্মরত আছেন। তিনি তার চিঠিতে লিখেছেন, ভোটসুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি। এ বিষয়ে বিঞ্চু পদ সিংহ ইত্তেফাককে বলেন, ‘নিজের সেফটির কথা বিবেচনায় ইউএনও অফিসে লিখিত দিয়েছি।’ এ বিষয়ে সাঘাটা ইউএনও সরদার মোস্তফা শাহীন বলেন, আমি এ ধরণের কোন লিখিত দেওয়ার নির্দেশনা দেইনি। প্রিজাইডিং অফিসাররা প্রত্যেকটা চিঠিতে সহকারী রিটার্নিং অফিসার মো. কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় ভোটবন্ধের কথা উল্লেখ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, প্রিজাইডিং অফিসাররা লিখিতভাবে আমাদের কোন চিঠি দেননি। তবে স্থগিত কেন্দ্রের ব্যাপারে প্রিজাইডিং অফিসাররা যে চিঠি দিয়েছেন সেখানে ভোটের পরিবেশ না থাকায় নির্বাচন বন্ধের কথা উল্লেখ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল মোবারক বলেন, নির্বাচন কমিশনের ভোটবন্ধের সিদ্ধান্ত যথাযথ। ভোটবন্ধ করে সঠিক কাজটাই করেছে ইসি। তবে প্রিজাইডিং অফিসাররা স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা সরকারি বা আধা সরকারি চাকরিজীবীরাই থাকেন। তারা বেশিরভাগই স্থানীয় প্রশাসন বা দলীয়ভাবে প্রভাবিত। তবে আলাদা করে ইউএনওর কাছে এভাবে প্রিজাইডিং অফিসারদের চিঠি দেওয়া কোনভাবেই ঠিক হয়নি। এটি নির্বাচন বিরোধী।
গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে আয়োজিত এক প্রেস বিফিংয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জানিয়েছেন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ নিজেই অন্যের ভোট দিয়েছেন। কমিশন থেকে ফোন দিয়ে প্রিজাইডিং অফিসারদের ভোটকেন্দ্রের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রিজাইডিং অফিসাররা ভোটকেন্দ্রের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ভূমিকা রাখেননি।
Array