সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধের সিদ্ধান্তকে ‘খারাপ পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখছে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করে শিক্ষাঙ্গনে ইতিবাচক ছাত্ররাজনীতির ধারা চালু রাখার পক্ষে দলটি। কারণ হিসেবে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, দেশ গঠনে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে। গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় সম্প্রতি পার্বত্যাঞ্চলে হঠাৎ সংঘাতে উদ্বেগ জানিয়ে, এর পেছনের ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করা নিয়েও আলোচনা হয়। এ ছাড়া জনগণের মনের ভাষা ও চাহিদা বুঝে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে তাগিদ দেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি গত ১৫ বছরে গুম, খুন, অন্যায়-নির্যাতনের দায়ে আওয়ামী লীগকে কেন বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না, সে বিষয়েও উদ্বেগ জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।
জানা গেছে, সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী চলা ওই বৈঠক শেষ হয় রাত ১১টার দিকে। এতে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান (ভার্চুয়ালি), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (ভার্চুয়ালি), সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু (ভার্চুয়ালি), মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম ও ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। অসুস্থ থাকায় সভায় যোগ দেননি স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়ে গত সোমবার অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উদ্বেগ জানানো হয়। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাধাগ্রস্ত হবে। কেননা, ’৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন, ’৬২ সালের পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পতনের আন্দোলনের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির বড় ভূমিকা রয়েছে। এখন ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দিলে কার ভালো হবে?
যারা অন্ধকারের মধ্যে কাজ করে, তাদের জন্য ভালো হবে। যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে কাজ করে, তারা লাভবান হবে। সুতরাং রাজনীতি থাকতে হবে, রাজনীতিকে গ্রহণ করতে হবে। বিরাজনীতিকরণ কোনো সমাধান নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করছে, এটা পুরোপুরি একটা খারাপ পদক্ষেপ। মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলে দেওয়াটা সমাধান নয়। কোথায় সমস্যা হচ্ছে, সেটা খুঁজে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করেই সমাধান হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য কালবেলাকে বলেন, দেশ চালান মূলত রাজনীতিবিদরা। এই সরকারকে বুঝতে হবে, আওয়ামী লীগকে শেষ হতে হয়েছে শুধু ভারতের সহযোগিতায় দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ভ্রান্তনীতির কারণে। ফলে, বর্তমান সরকার নির্বাচন দিতে দেরি করলে দেশ আবারও ঝুঁকিতে পড়বে। জনগণের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে।
বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ওই বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম, স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ আরও বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সম্প্রতি রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন স্থায়ী কমিটির নেতারা। কেউ কেউ বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ইন্ধনে তার দোসররা দেশে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে। পাহাড়ে হঠাৎ অস্থিরতা কেন হচ্ছে, তার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এর পেছনে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠোর হাতে সন্ত্রাসীদের দমন করার পরামর্শ দেন কেউ কেউ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে কোনো কোনো নেতা বলেন, স্থানীয় সরকারের সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলার চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করা হলেও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ক্ষেত্রে ভিন্ন নীতি বর্তমান সরকারের। দেশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন। ফলে ইউনিয়ন পরিষদে নাগরিক সেবা পেতে জনগণ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কোথাও কোথাও চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। তাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের ব্যাপারেও অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন স্থায়ী কমিটির নেতারা।
সভায় স্থায়ী কমিটির একাধিক স্থায়ী সদস্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের প্রসঙ্গটি আলোচনায় আনেন। বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে এবং যৌক্তিক সময় পর্যন্ত সেটি করবে। কিন্তু গত ১৫ বছরের গুম, খুন, অন্যায়-নির্যাতনের দায়ে আওয়ামী লীগকে কেন বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না, তা জানা দরকার বলেও মত দেন তারা। বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে আলোচনার কথা থাকলেও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেই। দেশ থেকে স্বৈরাচার বিদায় হলেও এখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি। এসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে বলে মনে করে বিএনপি।