যশোর জেলা প্রতিনিধি :
নিজেদের মণ্ডপে পূজা করছেন আরবপুর ইউনিয়নের সুজলপুর গ্রামের শাশ্বাসী দলিত নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার সদস্যরা। ছবি-সমকাল
নিজেদের মণ্ডপে পূজা করছেন আরবপুর ইউনিয়নের সুজলপুর গ্রামের শাশ্বাসী দলিত নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার সদস্যরা।
প্রতিমা তৈরি থেকে বিসর্জন, সবখানেই নারীদের নেতৃত্ব। দুর্গাপূজার মতো এমন বিশাল আয়োজন নিজ হাতে সামাল দেন নারীরাই। পূজার রীতিনীতিসহ আনন্দ-আয়োজনেও নারীদের অংশগ্রহণ। এভাবেই তিন বছর ধরে দুর্গাপূজার আয়োজন করে আসছেন যশোর সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়নের সুজলপুর গ্রামের শাশ্বাসী দলিত নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার সদস্যরা।
সেখানে নারীশক্তির জাগরণে পুরুষরা শুধু দর্শক মাত্র। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, পুরোহিতসহ এ আয়োজনে জড়িত সবাই দলিত। এটি সনাতন সমাজের প্রথা ভেঙে নতুনের দিকে যাত্রা। ব্যতিক্রম এ আয়োজনে পাশে থাকার কথা জানিয়েছে পূজা উদযাপন পরিষদ ও প্রশাসন।
নমঃশূদ্র, পৌন্ড্র ক্ষত্রিয়, ঋষি, জেলে, ডোম, হেলা, পাটনী কায়পুত্র, বাগদী, খাসি, বুনো, সরদার, কর্মকারসহ নানা সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া মানুষদের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রভাবশালীরা কোথাও স্থান ও সম্মান দেন না। আর দলিত নারীদের তাঁদের সম্প্রদায়ের পুরুষরা ঘরের বাইরে বের হতে দেন না। ফলে তাঁরা সমাজে আরও পিছিয়ে পড়ছেন। সে জন্য শাশ্বাসী দলিত নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থা নারীদের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে পূজা করে ইতিহাস তৈরির আয়োজন করেছে বলে জানালেন পূজা কমিটিতে থাকা দলিত নারীরা।
পূজা উদযাপনের জন্য গঠিত ১০ সদস্যের কমিটির ১০ জনই নারী। সংস্থার শারদীয় দুর্গোৎসবের সভাপতি জয়ন্তী রানী দাস ও সাধারণ সম্পাদক আয়নামতি বিশ্বাস (৩৭)। কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন আরতি দাস।
পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্তী রানী দাস বলেন, সংস্থার সভায় আলোচনায় উঠে আসে পুরষতান্ত্রিকতার চাপে দলিত নারীরা ঘর থেকে বের হতে পারেন না। এমনিতেই তাঁরা পিছিয়ে পড়া জাতি, তাঁদের পুরুষদেরও শিক্ষা নেই, অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই। তাঁরা নারীরা যাতে পরিবার ও সন্তানের ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারেন, সন্তানরা যাতে তাঁদের মতো অবহেলিত জীবনযাপন না করে, সে জন্য নারীদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও ঘর থেকে বের করে কাজে আনার জন্য তাদের নেতৃত্বে এই পূজা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা সমাজের অনেকের কটু কথা সহ্য করে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করছেন এবং শেষমেশ পূজা শুরু করতে পেরেছেন।
পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও এ এলাকার দলিত নারীদের মধ্যে প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক পাস আয়নামতি বিশ্বাস বলেন, এখানে ৮০০-এর মতো দলিত মানুষের বাস। তাঁদের মেয়েরাই শুধু নয়, ছেলেরাও শিক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে। এ জন্য তাঁরা নারীরা এগিয়ে এসেছেন অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। এই পরিবর্তনের ধাপ হচ্ছে দুর্গাপূজা। দুর্গা মায়ের আশীর্বাদে এবার থেকে তাঁদের অবহেলিত জীবনের পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন বলে তাঁর বিশ্বাস।
পূজা কমিটির কোষাধ্যক্ষ আরতি দাস বলেন, মাত্র ৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। শিক্ষা পাননি। এখনও অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো অধিকার পান না। এ জন্য তিনি চান তাঁর সন্তান শিক্ষিত হোক। সে জন্য ছেলেকে কলেজে ভর্তি করেছেন। মেয়ে এসএসসি দেবে। সমাজের প্রতিটি জায়গাতেই যেন পরিবর্তন ঘটাতে পারেন, সে জন্য তাঁরা নারীরাই এই পরিবর্তন ঘটানোর উদ্যোগ নেন। দুর্গা মাকে সামনে নিয়েই তাঁরা এগিয়ে যাবেন।
পূজা আয়োজনে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করা নীলরতন দাস বলেন, তিনি নিজেও দলিত সম্প্রদায়ের। তিনি যখন প্রথম পূজা শুরু করেন, তখন দেখেন ব্রাহ্মণরা বাধা দিত, অবজ্ঞা করত। সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দলিত নারীরা সমাজের আরও নিচের স্তরে আছে, তাদের নেতৃত্বে এই পূজা তাদেরকে মর্যাদার আসনে বসাবে। তিনি এই পূজার দায়িত্ব পেয়ে গর্বিত।
যশোর জেলা পূজা পরিষদের সভাপতি দিপাঙ্কর দাস রতন বলেন, সব স্থানেই তাঁরা দেখেন পুরুষরা পূজা-পার্বণের আয়োজন করেন। নারীরা তাঁদের পূজার কাজে সহজযোগিতা করেন। কিন্তু শাশ্বাসী দলিত নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার সদস্যরা তিন বছর ধরে পূজার আয়োজন করছে- যা শুধু নারীরাই আয়োজন করেন। এটা জেলার ব্যতিক্রমী একটি পূজা। যেখানে সবাই দলিত। এর মধ্য দিয়ে সনাতন সমাজের প্রথা ভেঙে নতুনের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে।
Array