অনলাইন ডেস্কঃ
রাজধানীর কল্যাণপুরে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার একটি প্রবীণ নিবাস। নিবাসের ছোট গেটের সামনে খাটিয়ায় একজনের মরদেহ সাদা কাফনে মোড়ানো। নিবাসের কেয়ারটেকারসহ কয়েকজন জানাজায় অংশ নিয়েছেন। তাঁরা মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া পড়ছেন। তবে দোয়া পড়া এই ব্যক্তিরা মৃত ব্যক্তির কোনো স্বজন নন।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন সমাদ্দার এই ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে ফেসবুকে লিখেছেন- ‘শেষবিদায়, পাশে নেই সন্তান, স্বজন, আপনজন। বাস্তবতা কতটা নির্মম। …পরপারে ভালো থাকুক এই জগতের অজ্ঞাত পরিচয়হীন মানুষগুলো।’
মিল্টন সমাদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, এ নিবাসে অনেকেই আছেন, যাঁরা একসময় দাপটের সঙ্গে সংসারের হাল ধরেছিলেন। ছেলেমেয়েদের অর্থবিত্তের মধ্যে বড় করেছেন। তবে ওই ছেলেমেয়ে বা স্ত্রী বৃদ্ধ বয়সে মানুষটিকে রাস্তায় ফেলে গেছেন। থানা-পুলিশের সহায়তায় আমরা যখন উদ্ধার করি, তখন অনেকের শরীরে ঘা ও পোকা ধরে গেছে।
বলতে গেলে নিবাসে আনার পর থেকেই মৃত্যুর প্রহর গোনেন তাঁরা। বিছানাতে প্রস্রাব-পায়খানা করেন অনেকে। পরিবারের সদস্যদের কাছে এসব মানুষ জঞ্জালে পরিণত হয়ে গেছে। তাই মৃত্যুর আগে খবর দিলেও অনেকে এসে শেষ দেখাটাও দেখে যান না। দাফন-কাফনের খরচ অনেক। নিবাস থেকেই তা মেটানো হয়।
এ ধরনের বাস্তবতায় আজ শনিবার দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে—পরিবর্তিত বিশ্বে প্রবীণ ব্যক্তির সহনশীলতা। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ প্রতিবছর ১ অক্টোবর দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। ২০১১ সালের আদমশুমারির হিসাবে, দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার। তাঁরা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, আগামী দুই থেকে আড়াই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ প্রবীণপ্রধান দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশ প্রবীণপ্রবণ সমাজে পদার্পণ করবে ২০২৯ সালে। আর সেখান থেকে ধীরে ধীরে প্রবীণপ্রধান সমাজ পরিণত হবে ২০৪৭ সালে। দ্রুততম সময়ে এই পরিবর্তন ঘটতে চলেছে, বিশ্বে এমন সব দেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
জনসংখ্যাবিদেদের মতে, মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ বা এর বেশি মানুষের বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলে সেটি তাদের দৃষ্টিতে প্রবীণপ্রবণ সমাজ (এজিং সোসাইটি)। আর মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ বা এর বেশি বয়স্ক মানুষ হলে সেটি প্রবীণপ্রধান সমাজ (এজড সোসাইটি)। এ ধরনের বাস্তবতায় আজ শনিবার দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে—পরিবর্তিত বিশ্বে প্রবীণ ব্যক্তির সহনশীলতা। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ প্রতিবছর ১ অক্টোবর দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে বর্তমানে প্রতি ৬ জনে ১ জন প্রবীণ নির্যাতনের শিকার, যাঁরা সংখ্যায় ১৪ কোটিরও বেশি। ২০১৪ সালে একজন প্রবীণকে নিয়ে প্রবীণ নিবাস শুরু করেছিলেন মিল্টন সমাদ্দার । এ পর্যন্ত আশ্রয় পেয়েছেন ১ হাজার ৬৯ জন প্রবীণ। রাস্তা থেকে তুলে আনার পর প্রবীণদের পরিবার নিয়ে গেছে ৫৩২ জনকে। আর এ পর্যন্ত নিবাসে মারা গেছেন ৩৯৮ জন।
বর্তমানে নিবাসী আছেন ১৩৯ জন। মিল্টন সমাদ্দার ৩৫ জন শিশুকেও আশ্রয় দিয়েছেন। প্রবীণ আর শিশুদের দেখভালের জন্য লোক আছেন ৫৫ জন। মিল্টন সমাদ্দার বললেন, মারা যাওয়াদের বেলায় বলা যায়, খুব কমসংখ্যকের স্বজনই দেখতে এসেছিলেন।
দেশের প্রবীণেরা যে ভালো নেই, তা বিভিন্ন পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে। গত বছর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের প্রবীণদের (৬০ বছর বা তদূর্ধ্ব) ৮০ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনশিয়া) ও বিষণ্নতার মতো অসংক্রামক রোগে ভুগছেন। দেশের এক-চতুর্থাংশ প্রবীণ অপুষ্টিতে ভুগেছেন। এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। অপুষ্টির হার পুরুষের তুলনায় নারীদের বেশি।
গত বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) করা এক গবেষণা বলছে, জীবনসঙ্গীবিহীন (বিধবা/ বিপত্নীক/ অবিবাহিত) প্রবীণদের মধ্যে অপুষ্টির হার ২৮ দশমিক ৬। প্রবীণদের ৬৫ দশমিক ৩ শতাংশ অপুষ্টির ঝুঁকিতে আছেন।
আমি বলব, তারা আসলে লাশ নিতে নয়, আসেন মারা যাওয়া মা-বাবার রুমে থাকা সম্পত্তির কাগজপত্র, টাকাপয়সা ও অন্যান্য সম্পদ নিতে। আমার এখানে যারা আছেন, তাঁরা বেশির ভাগই সমাজের উচ্চ পর্যায়ের নাগরিক। কেউ চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, উকিল অথবা সরকারি উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী ছিলেন একসময়। এই হলো বাস্তবতা
চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি নিজের বাসা থেকে ফেসবুক লাইভে এসে পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান। আবু মহসিন খান (৫৮) চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর। তিনি লাইভে এসে একাকিত্ব এবং নানা হতাশার কথা বলে গেছেন।
অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানের মৃতদেহ পাওয়া যায় তাঁর ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে। তিনি তাঁর ফ্ল্যাটে দুই বছর ধরে একাই বসবাস করছিলেন। একক পরিবারে অনেক প্রবীণের থাকার জায়গা হচ্ছে না। আবার অনেকে নিরাপত্তা বা ইচ্ছা করেই প্রবীণ নিবাসে থাকছেন। তবে মান-অভিমান বা যে কারণেই নিবাসে থাকুন, মৃত্যুর আগে অনেকেই স্বজনের মুখ একনজর দেখতে চান। তবে সে চাওয়া বেশির ভাগ সময়ই পূরণ হয় না।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসে যে প্রবীণেরা রয়েছেন, তাঁরা তুলনামূলকভাবে সচ্ছল। ছয় হাজার টাকা ঘরভাড়াসহ অন্যান্য খরচ দিয়ে থাকেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে প্রবীণ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। প্রবীণ হাসপাতালে টারসিয়ালি লেভেলের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। প্রাথমিক রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। যদি স্পেশালাইজড বা বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রে অসুস্থ প্রবীণের আত্মীয় বা স্বজন যাঁদের ঠিকানা আছে তাঁদের দ্রুত খবর দেওয়া হয়। বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে নিয়ে যান স্বজনেরা। কোনো স্বজন না এলে নিবাস কর্তৃপক্ষ বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের প্রবীণ নিবাসের ব্যবস্থাপক বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ মহসীন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘মারা যাওয়ার সময় সাধারণত প্রবীণেরা তাঁদের প্রিয়জন ও স্বজনদের বারবার দেখতে চান। এখানে এমন ঘটনাও আছে, আমি ছেলে, মেয়ে, নাতিকে ফোন দিচ্ছি, অনুরোধ করছি; কিন্তু কেউ আসছেন না। অজুহাত দেখাচ্ছেন তারা খুব ব্যস্ত। আমাকেই কিছু একটা ব্যবস্থা করতে বলেন। তখন মা-বাবার ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এর কথা বলে ভয় দেখাতে হয়।বলতে হয়, আপনারা যদি না আসেন তবে আমরা আপনাদের পরিচয় গণমাধ্যমে প্রকাশ করে দেব। ভয় পেয়ে কেউ কেউ তখন আসেন। অনেক সময় কেউ আসেন না। মৃত্যুর পর লাশ নিতে আসেন। আমি বলব, তারা আসলে লাশ নিতে নয়, আসেন মারা যাওয়া মা-বাবার রুমে থাকা সম্পত্তির কাগজপত্র, টাকাপয়সা ও অন্যান্য সম্পদ নিতে। আমার এখানে যারা আছেন, তাঁরা বেশির ভাগই সমাজের উচ্চ পর্যায়ের নাগরিক। কেউ চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, উকিল অথবা সরকারি উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী ছিলেন একসময়। এই হলো বাস্তবতা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ এস এম আতীকুর রহমান ১৯৮১ সালে প্রথম প্রবীণদের নিয়ে গবেষণা করেন। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আগারগাঁও-এর প্রবীণ নিবাসে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নিজের পরিবারের উদাহরণ দিয়ে বললেন, ‘৯২ বছর বয়সী মা হাসপাতালে ভর্তি। ভাবছি তিনি বাসায় ফেরার পর তাঁর যথাযথ দেখভালের দায়িত্ব পালন আমরা কীভাবে করব?
আবেগের চেয়ে প্রফেশনাল কেয়ারের দিকটাকে নজর দেওয়া সময় এসেছে। এখন মানুষ সহজে মারা যাচ্ছেন না। তাই অতি প্রবীণ বিশেষ করে নারীদের বিষয়টি আলাদাভাবে চিন্তা করতে হবে। যৌনকর্মী, হিজড়া বা সমাজ থেকে পিছিয়ে পড়া অতি প্রবীণদের কথা ভাবতে হবে। হাসপাতালে, ক্লিনিকে প্যালিয়েটিভ সেন্টার, আলাদা কোনো কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। প্রবীণদের শেষ বয়সের চিকিৎসা খরচ অনেক বেশি, এদিকটাতেও সরকারকে নজর দিতে হবে।’
অধ্যাপক এস এম আতীকুর রহমান বলেন, ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে স্বস্তিময় বার্ধক্য দশক হিসেবে পালিত হচ্ছে। সরকারের প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইনটির খসড়া গত প্রায় ১০ বছর হলো আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায় আছে। প্রবীণ বিষয়টিকে আর হেলাফেলা করার সুযোগ নেই, সরকারকে তা বুঝতে হবে।
প্রবীণ দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও সুরক্ষায় কর্মকৌশল এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। এ জন্য চলতি অর্থবছরে এ খাতের বরাদ্দ ৭ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা।
আজকালের বার্তা/ এফ.জে
Array