ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থের আবেদন অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্রকে পৃথিবীর জনপদে বুকটান দিয়ে দাঁড়াতে হলে অর্থে স্বাবলম্বী হওয়া জরুরি। অর্থ হলো মানুষ ও রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড। অর্থের জোগান উপেক্ষা করে কোনো মানুষ ও রাষ্ট্র সচল, সুস্থ ও সুন্দর সময় পার করতে পারে না।
প্রাণের ধর্ম ইসলাম মানুষকে সৎ পথে অর্থোপার্জনে উৎসাহিত করেছে। নিষেধ করেছে অসৎ পথে রোজগার। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, জুমুআর দিনে যখন নামাজের জন্য ডাকা হয়, তখন আল্লাহর স্মরণের দিকে শিগগিরই ধাবিত হও, ক্রয়-বিক্রয় পরিত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য অতি উত্তম, যদি তোমরা জানতে! অতঃপর যখন নামাজ সমাপ্ত হয়, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়, আর আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে থাক, যাতে তোমরা সাফল্য লাভ করতে পার।’ (সুরা: জুমুআ: ৯-১০)
হালাল ব্যবসা মানুষের জীবনে বয়ে আনে সফলতা ও সুখ্যাতি। নিয়ে আসে জান্নাতের সুসংবাদ। পক্ষান্তরে হারাম ব্যবসা মানুষের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে। ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। ইসলাম মানুষকে হালাল পন্থায় ব্যবসা পরিচালনার আদেশ করেছে। একজন মুসলিম ব্যবসায়ীর জন্য ইসলাম কতগুলো নৈতিক নির্দেশনা দিয়েছে, এই নির্দেশনাগুলো মেনে চললে সৎ ব্যবসায়ী হওয়া যাবে। নিচে নির্দেশনাগুলো উল্লেখ করা হলো—
সততা ও সত্যবাদিতা
প্রবাদ আছে, সততাই ব্যবসার মূলধন। সততা ও সত্য ছাড়া মানব জীবনে ব্যবসা কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। একজন ব্যবসায়ীর প্রথমত সততা ও সত্যতার গুণ থাকতে হবে। সততার ডানায় ভর করে তাকে চলতে হবে ব্যবসার অলি-গলিতে।
সত্যবাদী ব্যবসায়ীর জন্য নবী (সা.) দিয়েছেন মন-ভালোকরা সুসংবাদ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীর হাশর হবে নবী, সিদ্দিক ও শহিদদের সঙ্গে।’ (তিরমিজি: ১২০৯)
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা
বিক্রেতারা পণ্য বিক্রির সুবিধার্থে ক্রেতার সঙ্গে বিভিন্ন ওয়াদা করেন। ফলদায়ক কথা বলেন। পণ্যে কোনো সমস্যা হলে পরবর্তীতে ফেরত বা সার্ভিসিং করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু সমস্যা হলে ঘটে ভিন্ন চিত্র। প্রতিশ্রুতি পালন তো দূরের কথা; ক্রেতার সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া বাঁধিয়ে দেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন কর। নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৩৪)
আল্লাহর ভয়
ব্যবসা যদিও জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যম ও পূণ্যের কাজ তবে ব্যবসার চেয়ে আল্লাহকে ভালোবাসতে হবে বেশি। প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা কেয়ামতের দিন পাপী হিসেবে উত্থিত হবে, তবে যারা আল্লাহকে ভয় করে, নেক কাজ করে এবং সত্য বলে, তারা নয়।’ (তিরমিজি: ১২১০)
বিনয়ী ও নম্র্র হওয়া
বিনয়ী ও নম্রতার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। বিনয়ী ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয়। বিনয়ীকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভালোবাসেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিক্রয়কালে উদারচিত্ত, ক্রয়কালেও উদারচিত্ত এবং পাওনা আদায়ের তাগাদায়ও উদারচিত্ত আল্লাহ সেই বান্দার প্রতি দয়া করুন।’ (ইবনে মাজাহ: ২২০৩)
ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা নিষেধ
সৃষ্টির প্রভাত থেকেই মানুষ পরস্পরকে ধোঁকা দিয়ে আসছে। বিশেষ করে ব্যবসার মধ্যে ধোঁকা ও প্রতারণা চলছে আদিকাল থেকে। আজকাল ব্যবসাই যেন হয়ে উঠেছে ধোঁকা ও প্রতারণার বড় বাণিজ্যঘর। ধোঁকা ও প্রতারণার ব্যাপারে ইসলামে হুশিয়ারি দেয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তখন সে খাদ্যশস্য বিক্রয় করছিল। তিনি খাদ্যশস্যের স্তুপের মধ্যে তাঁর হাত ঢুকালেন এবং আদ্রতা অনুভব করলেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ধোঁকা দেয় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (ইবনে মাজাহ: ২২২৪)
সুদ ও ঘুষ না দেয়া
সুদ ও ঘুষ ইসলামে সবচেয়ে জঘন্য ও ঘৃণিত কাজ। সুদ-ঘুষ মানুষের মানবিক গুণও মূল্যবোধ ধ্বংস করে দেয়। মানুষের রক্ত শোষণ করে ফেলে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘মেরাজের রাতে আমাকে একদল লোকের কাছে নিয়ে আসা হলো। তাদের পেট ছিল ঘরের মতো বিশাল। তার মধ্যে সাপ ভর্তি ছিল, যা বাইরে থেকে দেখা যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম হে জিবরাইল, এরা কারা? তিনি বলেন, ‘এরা সুদখোর।’ (ইবনে মাজাহ: ২২৭৩)
মজুদদারি পাপ
বর্তমানে অনেক ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের নেশায় পণ্য মজুদদারি করে রাখে। যখন বাজারে পণ্যের অভাব দেখা দেয়, তখন তারা বেশি লাভে পণ্য বাজারজাত করে। এতে মানুষের ভোগান্তি ও কষ্ট হয়। জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। ইসলামে পাপ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেবল পাপী ব্যক্তিই মজুদদারি করে।’ (মুসলিম: ১৬০৫)
ন্যায় ও ইনসাফের সঙ্গে ব্যবসা করা
ন্যায় ও ইনসাফ মানুষকে সম্মানিত ও সমাদৃত করে। আখেরাতের জীবনে সে লাভ করে সুখ-শান্তির সুবিশাল জান্নাত। সুতরাং আল্লাহর ভয় ও মৃত্যুর ভয় স্মরণে রেখে ব্যবসা করতে হবে। ইনসাফ ও ন্যায়ের সঙ্গে ব্যবসা করতে হবে। আল্লাহর ভয় আর মৃত্যুর স্মরণ মানুষকে সৎ ব্যবসায়ী হতে সাহায্য করে। আল্লাহ বলেন, ‘জীবন মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কেয়ামতের দিন তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় দেয়া হবে।’ (সুরা ইমরান: ১৮৫)
আমাদের জীবন চলার জন্য প্রয়োজন অর্থের। পৃথিবীর বুকে মেরুদণ্ড সোজা করে দেশকে দাঁড়াতে প্রয়োজন অর্থের। এই অর্থ উপার্জনের বরকতময় সুন্দর পদ্ধতি হলো ব্যবসা। সুতরাং ব্যবসা হোক জীবন ও রাষ্ট্রের কল্যাণার্থে। ব্যবসা পরিচালিত হোক কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা ও নিয়মনীতির ভেতর।
Array