কেবলই নদী কিংবা সাগরে নৌকায় ভেসে ভেসে মাছ শিকার করে চলে তাদের জীবন-সংসার। নিজস্ব কোনো ভূমি না থাকায় মৃত্যুর পর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় তাদের মরদেহ। ব্যতিক্রমী জীবনের এ মানুষগুলো ‘মানতা সম্প্রদায়’ নামে পরিচিত।
বরিশালের বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে নৌকায় বসবাসকারী মানতা সম্প্রদায়ের পরিবারগুলোর জীবন চিত্র এমনই।
মাছ শিকার করে মানুষের আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ক্ষুদ্র হলেও দেশের অর্থনীতিতে এদের ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামেও তাদের কারো কারো ভূমিকা আছে। কিন্তু শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান নেই তাদের। নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থা, পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান কিংবা বিশুদ্ধ পানির সুবিধা।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার পেলেও নাগরিক হিসেবে কতটুকুই বা সুবিধা ভোগ করতে পারেন তারা? জনপ্রতিনিধিরাই বা তাদের কতটুকু খোঁজ রাখেন, এমন প্রশ্নও আছে।
সচেতনতা ও সুযোগের অভাবে এই সম্প্রদায়ের সন্তানরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। সামান্য অক্ষরজ্ঞানও অর্জন করতে পারে না তারা। বড় হয়ে তাদের বেছে নিতে হয় মা-বাবার মাছ ধরার সেই পেশাকেই।
মানতা সম্প্রদায়ের বিয়ে ও তালাকের বিষয়ে রয়েছে চমকপ্রদ তথ্য। এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায় পছন্দের মেয়েটিকে তুলে নিলেই হয়ে যায় বিয়ে! আবার দাম্পত্য কলহের কারণে যদি ছাড়াছাড়ি হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে ওই বধূ স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তালাক হয়ে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কারো কারো বিয়ে রেজিস্ট্রির মাধ্যমেও হচ্ছে।
এদিকে, মানতা সম্প্রদায় জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার না করায় দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে। মাছ শিকারের সময় নৌকায় শিশু সন্তানকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়, যাতে করে পানিতে পড়ে না যায়। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহ এই সম্প্রদায়ে অন্যতম রীতি।
বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে নৌকায় বসবাসকারী প্রায় ৩০টি মানতা পরিবারের সর্দার কাশেম। তিনি জানান, তিনি এ পর্যন্ত পাঁচটি বিয়ে করেছেন। একাধিক বিয়ে করলে লাভ হয় তাদের। কারণ মাছ শিকারে পুরুষের চেয়ে মেয়েরা বেশি দক্ষ। তার পাঁচ স্ত্রী মাছ ধরে বিক্রির টাকা সবই তুলে দেন তার হাতে। এতগুলো স্ত্রী নিয়ে বেশ সুখেই আছেন বলে জানান।
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, মুলাদী, হিজলা, বানারীপাড়া, শরীয়তপুর, মাদারীপুরের কালকিনি, উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর পানপট্টি, চরমনতাজ, গলাচিপা, কালাইয়া, বগা, পাটুয়া, বদনাতলী, উলানিয়াসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদী ও মোহনাগুলোতে এ সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার লোক নৌকায় বসবাস করছে বলে জানান সর্দার কাশেম।
অবহেলিত মানতা পরিবারগুলো যাতে সব মৌলিক ও নাগরিক সুবিধা পায় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর দাবি জানিয়েছেন তিনি।
সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে মানতা সম্প্রদায়ের কেউ কেউ জমি কিনে সেখানে বাসস্থান গড়ে তুলছেন। তবে সেই সংখ্যা হাতেগোনা।
বানারীপাড়া পৌরসভার মেয়র ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র শীল ১ নম্বর ওয়ার্ডে সন্ধ্যার তীরে জেগে ওঠা চরে কয়েক একর সরকারি ভূমিতে কবরস্থান করে দিয়েছেন। মানতা সম্প্রদায় ও ভূমিহীন পরিবারের সদস্যদের সেখানে দাফন করা হয়।