জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গণহত্যার অভিযোগে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এর ভিত্তিতে তাকে দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, পরোয়ানা জারি করে বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলেই হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে—এমন সরলভাবে বিষয়টি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। কারণ হাসিনার ফেরা-না ফেরার বিষয়টি এখন নির্ভর করছে ভারত সরকারের অবস্থান এবং সিদ্ধান্তের ওপর।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দেশত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর থেকে সেখানেই রয়েছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তাকে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়ার পর এ প্রসঙ্গে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। তবে একই দিনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে একজন সাংবাদিক বিষয়টি নিয়ে দেশটির অবস্থান জানতে চান। জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) ভারতে চলে আসার বিষয়ে আগেই জানানো হয়েছিল, নিরাপত্তার কারণে অল্প সময়ের নোটিশে তিনি ভারতে চলে এসেছিলেন। এখনো আছেন, থাকবেন।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত পর্যায়েও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তাই নানা সমালোচনার পরও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে তারা হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বক্তব্য থেকেও স্পষ্ট যে, হাসিনার ব্যাপারে ভারতের অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। তাই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনাকে ফেরত চাইলেই ভারত তাকে ফিরিয়ে দেবে—সমীকরণটা এত সহজ নাও হতে পারে। কারণ তাকে ফেরত দেওয়া না দেওয়ার বিষয়টি এখন ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং দুই দেশের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ‘বল’ এখন পুরোপুরিভাবে ভারতের ‘কোর্টে’।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ফেরারি আসামি ও বন্দিদের একে অন্যের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে একটি চুক্তি রয়েছে ২০১৩ সাল থেকে। চুক্তি অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তির নামে তার দেশে মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয় কিংবা তিনি দোষীসাব্যস্ত হন অথবা আদালত কর্তৃক প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের জন্য সাজাপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন এবং তার দেশের সরকার তাকে ফেরত চাইলে অন্য দেশ তাকে ফিরিয়ে দেবে। তবে চুক্তিতে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ’ সর্বনিম্ন এক বছরের কারাদণ্ড হয় এমন অপরাধকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর্থিক অপরাধও এ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত। আবার অপরাধ ‘প্রত্যর্পণযোগ্য’ হওয়ার জন্য দ্বৈত অপরাধের নীতি অবশ্যই প্রযোজ্য হবে অর্থাৎ অপরাধটি অবশ্যই দুই দেশের আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য হতে হবে। চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে, অপরাধ ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ হলে যে কোনো দেশ প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে।
তবে চুক্তি অনুযায়ী হত্যা, নরহত্যা বা অপরাধমূলক হত্যা, আক্রমণ, বিস্ফোরণের কারণ, জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক পদার্থ বা অস্ত্র তৈরি বা নিজের কাছে সংরক্ষণের মতো ঘটনাকে রাজনৈতিক বলার সুযোগ নেই।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিটি ২০১৩ সালে করা হলেও ২০১৬ সালে মূল চুক্তিটি সংশোধন করা হয়। সংশোধনের সময় এমন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছিল, যা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বেশ সহজ করে তুলেছিল। সংশোধিত চুক্তির ১০ এর (৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেসব অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ না করলেও চলবে শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে।
কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত দুই মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুইশরও বেশি মামলা হয়েছে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে। চুক্তি অনুযায়ী আদালত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও তাকে ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দরকার হতে পারে। অর্থাৎ আইন ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে সমন্বয় হলেই কেবল শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে পারে ভারত। তবে এখনই সে সুযোগ দেখছেন না বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ কালবেলাকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী আইনগতভাবে ভারতের কাছে বাংলাদেশ অনুরোধ করতেই পারে। কিন্তু এখানে ভারতেরও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার অনেক বিষয় আছে। এখানে ভারত সরকার না চাইলে কিছুই হবে না। আমাদের সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিন্তু ভারত সরকার যদি না চায় তাহলে তাকে (শেখ হাসিনা) ফেরত আনা সম্ভব নয়। তারা তো গতকালও (বৃহস্পতিবার) স্পষ্ট করে বলেছে, সে এখানেই আছে, এখানেই থাকবে। তাকে ফেরত দেওয়া-না দেওয়ার বিষয়ে বল পুরোপুরি ভারতের কোর্টে।
তিনি আরও বলেন, এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই শেখ হাসিনার নিজেরও একটা সিদ্ধান্ত আছে। সেটা তো এখনো কেউ জানে না। যেহেতু তাকে ভারত সরকার আশ্রয় দিয়েছে, সবকিছু আসলে ভারতের ওপরই নির্ভর করবে। বিষয়টা অনেকটা কানাডায় আশ্রয় নেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূর চৌধুরীর মতো। কানাডা তাকে ফেরত দিতে চাচ্ছে না। এক্ষেত্রে কিছু করারও নেই। এখানেও বিষয়টা অনেকটা তেমন। যতক্ষণ ভারত না চাইবে, ততক্ষণ সম্ভব নয়। আমাদের সরকার তো চেষ্টা করবেই। চেষ্টা দেখাতেও হবে। সরকার যদি কিছু না করে, সেটাও একটা রাজনৈতিক বিষয় হয়ে যাবে, যে সরকার কিছুই করছে না।
কূটনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. এম হুমায়ুন কবির কালবেলাকে বলেন, বন্দিবিনিময় চুক্তি অনুযায়ী আমরা তাকে ফেরত আনার অনুরোধ করতেই পারি; কিন্তু সেটা রাখা হবে কি হবে না সেটা ভারতীয় এবং তার নিজের (শেখ হাসিনার) সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। শেখ হাসিনা যদি মনে করেন তিনি দেশে এসে আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলা করবেন কিংবা যদি চান যে তিনি ভারতেই থাকবেন, তাহলে ভারত সরকারের সহায়তা চাইবেন। আইন অনুযায়ী আইনি প্রক্রিয়া চলবে। আমাদের দিক থেকে ভারতের কাছে যতটুকু আইনি সহায়তা পাওয়া দরকার, সে ব্যাপারে তাদের কাছে অনুরোধ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, তবে এখানে দুটি বিষয় আছে—শেখ হাসিনার নিজের মতামত এবং এ ব্যাপারে ভারত সরকারের অবস্থান এবং এই দুইটা বিষয় এখনো অনিশ্চিত। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে অনুরোধ করা হবে; কিন্তু এরপর কী হবে সেটা এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
Array