প্রাথমিকেই শিশুর শিক্ষার ভিত তৈরি হয়। কিন্তু যারা সেই ভিত রচনা করেন, সেই শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়েই আছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার হলেও তাদের ভাগ্যের খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। উচ্চ মাধ্যমিক এবং ডিপ্লোমা পাসের যোগ্যতায় নার্স, উচ্চ মাধ্যমিকসহ চার বছরের ডিপ্লোমা যোগ্যতায় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, স্নাতক যোগ্যতায় পুলিশের এসআই এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় দশম গ্রেড পান। কিন্তু প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম এবং প্রধান শিক্ষকরা পাচ্ছেন ১২তম গ্রেড। এমন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষকের কণ্ঠস্বর: শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার’।
দিবসটি উপলক্ষে সকাল ১০টায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বিশেষ অতিথি থাকবেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ এবং ইউনেস্কোর ঢাকা অফিসের প্রধান ড. সুজান মারি ভাইজ। এ ছাড়া, শিক্ষক সংগঠনগুলোও নানা কর্মসূচি পালন করবে।
‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন নীতিমালা-২০২৪’ অনুযায়ী, এখন থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে দিবসটি উদযাপন করা হবে। প্রতি বছর ১২ জন গুণী শিক্ষক পাবেন সম্মাননাও।
জানা যায়, প্রাথমিকের শিক্ষকরা নিজেদের মর্যাদা রক্ষায় বিগত সময়ে বিভিন্ন দাবি তুলেছেন; কিন্তু সেগুলো পূরণ হয়নি। তাদের আশা, শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে তারা দাবি পূরণের আশ্বাস পাবেন। দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—শিক্ষক সুরক্ষা আইন প্রবর্তন; স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন; সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড এবং প্রধান শিক্ষকদের নবম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ; যোগ্যতার ভিত্তিতে শতভাগ পদোন্নতি; প্রধান শিক্ষক থেকে ওপরের পদগুলোতে নিয়মিত পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে; অষ্টম পে-স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল; প্রতি তিন বছর পরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে শ্রান্তি বিনোদন ভাতা দিতে হবে;
নন-ভ্যাকেশনাল ঘোষণা করে সরকারের অন্য বিভাগের মতো সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে এবং চাকরি দুই বছর পূর্ণ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থায়ীকরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে প্রভৃতি।
শিক্ষক নেতারা বলেন, অষ্টম শ্রেণি পাস একজন সরকারি গাড়িচালক ১২তম গ্রেডে বেতন পান, উচ্চ মাধ্যমিক এবং ডিপ্লোমা পাসের যোগ্যতায় নার্সরা জাতীয় পে-স্কেলের দশম গ্রেড পাচ্ছেন, উচ্চ মাধ্যমিকসহ ৪ বছরের ডিপ্লোমা যোগ্যতায় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকতারা দশম গ্রেড, পুলিশের এসআইরা স্নাতক যোগ্যতায় দশম গ্রেড এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় দশম গ্রেড পাচ্ছেন। অথচ স্নাতক পাস একজন প্রাথমিক শিক্ষক পান ১৩তম গ্রেড। তাই সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেডে উন্নীত করা এবং প্রধান শিক্ষকদের নবম গ্রেড বাস্তবায়ন করার দাবি জানাই।
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের সভাপতি শাহিনুর আল-আমীন কালবেলাকে বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও প্রাথমিকের শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। এটি দেশের জন্য লজ্জার। এখন সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেড, প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে নন-ক্যাডার থেকে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা ১২তম এবং আগের নিয়োগপ্রাপ্তরা ১১তম গ্রেড পাচ্ছেন। এখন যেহেতু বৈষম্যবিহীন সরকার দায়িত্বে, তাই প্রধান শিক্ষককে নবম এবং সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেডে বেতন দেওয়ার অনুরোধ থাকবে। এ ছাড়া শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেওয়া আমাদের প্রাণের দাবি।
তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ প্রাথমিকের শিক্ষকতার যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয় স্নাতক। কিন্তু সবার মেধা ও শিশুর মানসিকতা বোঝার সক্ষমতা এক নয়। সে কারণে শিক্ষকদের চাইল্ড সাইকোলজির ওপরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, মেধাবীদের শিক্ষকতায় আনতে হলে বেতন বৈষম্য দূর এবং মর্যাদা দিতে হবে। তাই মামলায় রায় পাওয়ামাত্র প্রধান শিক্ষকদের ২০১৪ সালের ৯ মার্চ থেকে দশম গ্রেড ও পরবর্তী সময়ে নিয়োগ পাওয়াদের নবম গ্রেড এবং সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড দেওয়ার দাবি জানাই। মর্যাদার ক্ষেত্রে প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকের প্রথম শ্রেণি এবং সহকারী শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার দাবি তার।
মাদ্রাসা শিক্ষকদের দাবি
মাদ্রাসা শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো জাতীয়করণ করা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের পিটিআই ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করাসহ বেশ কয়েকটি দাবি রয়েছে। এসব দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলনও করেছে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক ঐক্যজোটসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।
মাধ্যমিকের শিক্ষকদের দাবি
সরকারি নিয়মে বাড়ি ভাড়া, পূর্ণাঙ্গ উৎসব বোনাস, চিকিৎসা ভাতা, সরকারি শিক্ষকদের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পেনশনে অন্তর্ভুক্তকরণ, ইনডেক্সধারীদের বদলি ও প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী প্রধান শিক্ষকদের পদোন্নতি নিয়োগ কমিশন গঠনপূর্বক নিয়োগের দাবি মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির।
অন্যদিকে মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির দাবি, সরকারি মাধ্যমিকের এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষকদের নবম গ্রেডে বেতন, বিভিন্ন শূন্যপদ দ্রুত পূরণ, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মঞ্জুরি আদেশ এবং অগ্রিম বর্ষিত বেতন সমস্যার সমাধান, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদে সিনিয়র শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের পদায়ন, প্রকল্পের জনবলকে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তি না করা, কারিকুলাম প্রণয়ন ও বিস্তরণে মাধ্যমিকের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং সরকারি মাধ্যমিকে আইসিটি শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করার পাশাপাশি হিন্দুধর্মীয় শিক্ষক এবং সহকারী গ্রন্থাগারিক পদ সৃষ্টি করে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া।
জানা গেছে, মাধ্যমিক স্তরে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরেই জাতীয়করণ চান। এ দাবিতে গত বছর টানা এক মাস কর্মসূচিও পালন করেন। তখন সরকারের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন করে দেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. বজলুর রহমান মিয়া বলেন, গত বছর এক মাসের বেশি সময় আন্দোলনের পর সরকার মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের অঙ্গীকার করে। কিন্তু তখন আওয়ামীপন্থি কিছু শিক্ষক সংগঠন সরকারকে ভুল বোঝায়। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয় থেকে কমিটি গঠন করে কিছু কাজ হয়েছিল; কিন্তু শেষ করা হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারকে কিছুটা সময় দিতে চাই। এরপর শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে বসব। তাতে কাজ না হলে আবারও মাঠে নামব। অন্যদিকে, নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলন করছে।
কারিগরি শিক্ষকদের দাবি
বাংলাদেশ পলিটেকনিক নন-গ্রেডেড টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাপনটিএ) বলছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশ অনুযায়ী ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর পদটি ব্লক নয়। তারপরও ‘ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর শিক্ষক’ পদটিকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। তাদের দাবি, ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের শিক্ষকের মর্যাদা দিতে হবে। অন্যদিকে, পলিটেকনিক এবং টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষক সংকট এবং সুযোগ-সুবিধাও অপ্রতুল। পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি এসব ঘাটতি পূরণের দাবি জানিয়েছেন।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দাবি
শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণ, শিক্ষকদের ধারাবাহিক ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের শতভাগ উৎসব ভাতা, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা প্রদান, বেসরকারি কলেজে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি, শিক্ষা প্রশাসনে বেসরকারি শিক্ষকদের আনুপাতিক হারে পদায়ন নিশ্চিত, অনতিবিলম্বে শিক্ষক নিয়োগ, বদলি ও পদায়নের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন করাসহ বিভিন্ন দাবি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠনগুলোর।
সার্বিক বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ কালবেলাকে বলেন, শিক্ষকদের যেসব দাবি আছে, সেগুলো বিবেচনায় রয়েছে। যেগুলো দ্রুত পূরণ করা সম্ভব, সেগুলো অগ্রাধিকার পাবে। কিছু আছে সময়সাপেক্ষ, সেক্ষেত্রে হয়তো সময় লাগবে। তবে শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি পূরণের চেষ্টা করব।
Array