শরীয়তপুর প্রতিনিধি: পদ্মার বুকে দেশের টাকায় নির্মিত হয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু। সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কেটেছে এক বছর হলো। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপন হওয়ায় জীবন মান ও ব্যবসায় নতুন মাত্রার সূচনা হলেও সচেতনতা বাড়েনি পদ্মা পাড়ের সাধারণ মানুষের। পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাসহ বেশ কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সারাদেশে। এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটেছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সচেতনতার অভাবে।
সর্বশেষ গত ২২ জুন ঢাকা-ভাঙা মহাসড়কের জাজিরা প্রান্তে শিশুসহ রাস্তা পারাপার, গাড়ি পার্কিং করে ছবি তোলা ও বাসগাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামার কয়েকটি স্থির ছবি ও ভিডিও ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। যেখানে দেখা যায় বাচ্চা নিয়ে দুজন মা পায়ে হেটে মহাসড়ক পার হচ্ছেন। এছাড়া মহাসড়কে এখনও যাত্রীরা আগের সরু সড়কের মতো যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে ওঠানামা করছে। যার ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও প্রশাসন এসব বিষয়কে কঠোর হস্তে দমন করার জন্য বারবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। তবুও এ অঞ্চলের মানুষের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ছে না যেন কিছুতেই। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সেতুর জাজিরা প্রান্তের কাছাকাছি এলাকার সাধারণ মানুষের একটাই উত্তর আমাদের বৈধ কোনো স্টপেজ না থাকার কারণে মানুষ সেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন ইতোমধ্যে পদ্মাসেতুর জাজিরা প্রান্তের নাওডোবায় একটি স্টপেজ করার প্রস্তাব দিয়ে আবেদন করেছে। আবেদনে রয়েছে স্থানীয় সাংসদ ও জনপ্রতিনিধিদের সুপারিশ। সেতুর আশপাশের জমিগুলো পদ্মা সেতু ও মহাসড়কের নামে বরাদ্দ থাকায় হুটহাট করে স্টপেজ করা সম্ভব নয়। বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে, তারা অনুমোদন দিলেই সুন্দর একটি জায়গায় নির্মাণ হবে স্টপেজ, ওয়াসব্লক।
পদ্মা সেতু নাওডোবা এলাকার বাসিন্দা দেলোয়ার মুন্সী বলেন, আমরা যদি বৈধভাবে গাড়িতে উঠতে চাই তাহলে আমাদেরকে পার্শ্ববর্তী জেলার পাচ্চর গিয়ে গাড়িতে উঠতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক কথায় আমরা ভিটেমাটি, জায়গা-জমি ছেড়ে দিয়েছি সুন্দর জীবন নিশ্চিত করার জন্য। আমাদের ছেড়ে দেওয়া জমির উপর দিয়ে পদ্মা সেতু ও মহাসড়ক নির্মাণ হয়েছে কিন্তু আমাদের গাড়িতে ওঠার জন্য বৈধ কোনো স্টপেজ নেই। আশপাশের প্রায় ১০টি ইউনিয়নের মানুষ এখান থেকে প্রতিদিন গাড়িতে উঠে ঢাকা যাতায়াত করে। মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামার কারণেই কিছুদিন আগেও দুজন শিশু মারা গেছে। যারা মহাসড়কে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হয় তারা নিরুপায় হয়েইে এই কাজটি করেছে।
মো. শাহিন নামে অন্য একজন বাসিন্দা বলেন, এখানে যদি স্টেশন থাকত, যাত্রী ছাউনীসহ টয়লেটের ব্যবস্থা থাকত তাহলে মানুষ এভাবে হাইওয়ের ওপর দিয়ে দৌঁড়াদৌড়ি করত না। সরকার চাইলে আশপাশের আরও জায়গা নিয়ে যাক, তবুও আমরা এখানে স্টেশন, যাত্রী ছাউনী চাই। জায়গা জমি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় যেতে চাই না। আমরা সড়ক আইন মেনে বৈধভাবে গাড়িতে চলাচল করতে চাই।
মিজান ঢালী নামে একজন যাত্রী মহাসড়কে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঢাকার গাড়িতে ওঠার অপেক্ষায়। তিনি বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়কে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। কোন সময় পেছন থেকে এসে দ্রুত গতির গাড়ি আমার জীবন কেড়ে নেয় তা জানি না। নাওডোবায় একটি বাস স্টপেজ নির্মাণ হলে আমরা জীবনের ঝুঁকি থেকে বেঁচে যাই।
সেলিম ঢালী নামে আরেকজন বলেন, নিরুপায় হয়ে আমরা মহাসড়কে দাঁড়িয়ে গাড়িতে উঠি। এটা অন্যায় করছি জেনেও জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছি এক বছর ধরে। আমরা এর থেকে মুক্তি চাই।
শরীয়তপুর জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফারুক আহমেদ চৌকিদার বলেন, আমরা নাওডোবাতে একটি স্টেশন তৈরির জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। যাত্রীরা খুবই ভোগান্তিতে আছেন। গাড়ির শ্রমিকরাও ঝুঁকিতে রয়েছে। যদি দ্রুত বাস স্টেশনের ব্যবস্থা করা যেত তাহলে অনেক ভালো হতো।
বিষয়টি নিয়ে জাজিরা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কামরুল হাসান সোহেল বলেন, যারা এখনও সচেতন হতে পারেনি মহাসড়কের চলাচলের বিষয়ে তারা নিশ্চয়ই ঝুঁকিতে রয়েছেন। মানুষকে আমরা বুঝানোর চেষ্টা করেছি, প্রয়োজন ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচানা করেছি। বাস মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা একটি আবেদন করেছেন। আবেদনটির বিষয়ে আমাদেরও মতামত চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে আমরা আমাদের মতামত দিয়েছি। নাওডোবা এলাকায় বাস স্টেশন নির্মাণ করা যাবে কি না এবিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ তাদের মতামত নিয়েই স্টেশন করা হবে। একটি নিরাপদ বাস স্টেশন হলে আমাদের সকলের জন্যই ভালো হয়। নাওডোবায় অনেক যাত্রী ওঠানামা করে, এখানে কোনো ওয়াসব্লক নেই, যাত্রী ছাউনি নেই। আমরা চাইলেই এসব করতে পারি কিন্তু অনুমতির প্রসঙ্গ থাকায় তা করা যাচ্ছে না। বাস স্টেশন নির্মাণের বিষয়টি পরীক্ষামূলক রয়েছে। আশা করছি স্টেশন নির্মাণের বিষয়টি সুন্দরভাবে সমাধান হবে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) শরীয়তপুর জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট মুরাদ হোসেন মুন্সী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা মানুষকে সড়কে চলাচলের বিষয়ে সচেতন করে যাচ্ছি কিন্তু মানুষ তা শুনছে না। প্রশাসনকে আরও কঠোর হওয়ার অনুরোধ করছি আমরা।
Array