বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। দ্বীপটির চারপাশেই সাগর। সমুদ্রের নীল জলরাশিতে বালুকাময় সমুদ্র সৈকত বলা হয় সেন্টমার্টিনকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ দৃশ্য আগলে রাখায় সেন্টমার্টিন থাকে পর্যটকদের প্রথম পছন্দের। কিন্তু এবার সেই সেন্টমার্টিন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখা সরাসরি আঘাত হানবে সেন্টমার্টিন ও মিয়ানমার উপকূলে এমনটাই জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক এবং আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে আশংকা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপের বড় একটি অংশ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে। যারা সেন্টমার্টিন দ্বীপে আটকা পড়ে আছে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা না হলে প্রাণহানির সম্ভাবনা রয়েছে।
এ গবেষকের পর্যবেক্ষণ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার পূর্বাভাস মডেলের নির্দেশনা অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় মোখা স্থলভাগের প্রথম যে স্থানটিতে আঘাত করবে তা হলো সেন্টমার্টিন দ্বীপ।
সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত একটি ছোট প্রবাল দ্বীপ। মাত্র আট বর্গকিলোমিটারের দ্বীপ এটি। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ হতে প্রায় নয় কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমার উপকূল হতে আট কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। স্থানীয়রা একে ‘নারিকেল জিনজিরা’ নামে চেনেন। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা যা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ সমতল ও সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা থেকে ৩ দশমিক ৬ মিটার ওপরে। মূল ভূখণ্ড ও দ্বীপের মধ্যবর্তী নয় দশমিক ৬৬ কিলোমিটার প্রশস্ত প্রণালি দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমের উন্মুক্ত সাগরের তুলনায় অনেক অগভীর। এখানে পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর। মূল দ্বীপ ছাড়াও এখানে ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তন বিশিষ্ট কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রয়েছে, যেগুলো স্থানীয়ভাবে ছেড়াদিয়া বা সিরাদিয়া (ছেঁড়া দ্বীপ) নামে অভিহিত করা হয়। যার অর্থ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
ছেঁড়া দ্বীপ হলো বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণের সর্বশেষ বিন্দু। দক্ষিণ দিকে এরপর বাংলাদেশের আর কোনো ভূখণ্ড নেই। সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। এছাড়া রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। ঘূর্ণিঝড় মোখায় প্রবাল এ দ্বীপ ভয়ঙ্কর ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক বিজ্ঞানী ড. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘মোখার প্রভাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পানির নিচে চলে যাবে, এটা নিশ্চিত। তবে সেটা স্থায়ীভাবে নয়। পাঁচ থেকে সাত ফুট জলোচ্ছ্বাস হলে তো সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভেসে থাকার কথা নয়। শুধু জলোচ্ছ্বাস নয়, আজ থেকে আগামীকাল পর্যন্ত সেন্টমার্টিনে ভরা জোয়ার আছে। সব ঘূর্ণিঝড় অমাবস্যা অথবা পূর্ণিমাতে আসে। অমাবস্যা ও পূর্ণিমাতে জোয়ারের উচ্চতা সবচেয়ে বেশি হয়। সেন্টমার্টিনে আজ ভরা জোয়ার থাকবে এবং আগামীকাল কিছুটা কমবে। এবার সেন্টমার্টিনের জোয়ার কিন্তু পিক টাইমই ফলো করছে। মানে মোখা উপকূলে আসার সাথে সাথেই জলোচ্ছ্বাস শুরু হবে।’
সাবেক এ আবহাওয়াবিদ আরও বলেন, ‘তবে, ঘূর্ণিঝড় সেন্টমার্টিনের ওপর দিয়ে গেলেও দ্বীপটিতে কিছু সুবিধা আছে। কারণ, আমরা এখন পর্যন্ত যেভাবে দেখছি তাতে ঘূর্ণিঝড়ের বাম পাশে পড়ে যায় সেন্টমার্টিন। এছাড়া, সেন্টমার্টিনে তলিয়ে গেলেও কিন্তু পানি বের হয়ে যাবে। কারণ, চারপাশে খোলা বিচ। মানে একপাশে দিয়ে আসলেও আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে যাবে। এটা আবার স্থলভাগে হয় না।’
‘তবে, মিয়ানমার উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা অনেক বেশি হবে। কারণ, মিয়ানমার ঘূর্ণিঝড় মোখার ডান পাশে হওয়াতে এর ওপর প্রভাবটা বেশি হবে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়গুলো ডান পাশে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। সেক্ষেত্রে মিয়ানমারের তুলনায় বাংলাদেশে কিছুটা কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এনভায়রমেন্টাল ওশানোগ্রাফি ও ক্লাইমেট বিভাগের সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার ও বিভাগীয় প্রধান আবু শরীফ মো. মাহবুব-ই-কিবরিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিল্ডিংগুলো সাইক্লোন সেল্টার আদলে করা। ঘূর্ণিঝড় মোখার জন্য আমাদের অফিসটাও শেল্টার হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া, সেন্টমার্টিন তলিয়ে না গেলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। বিশেষ করে দুর্বল স্থাপনা এবং জেলেদের ক্ষতি হবে।’
‘তবে, সেন্টমার্টিন তলিয়ে গেলেও খুব দ্রুত সময়েই পানি বের হয়ে যাবে। এটা স্থায়ীভাবে তলিয়ে যাবে না বলেই আমার ধারণা।’
সমুদ্রের প্রাণীদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোখায় যদি সাগরের কোনো প্রাণী মরে ভেসে আসে তাহলে আমাদের র্যাপিড রেসপন্স টিম দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নেয়। সরকারের অন্যান্য দপ্তরগুলোর সহযোগিতা নিয়েই আমরা কাজগুলো করি। কোনো প্রাণী মরে ভেসে আসলে আমরা প্রথমেই বিজ্ঞানীর টিম পাঠাই এবং তারাই পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তবে, এরকম ঘূর্ণিঝড় সাগরে ফুড চেইনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রোটিনগুলো টার্বুলেন্টের মাধ্যমে নিচ থেকে ওপরে আসে এবং ঘূর্ণিঝড়টি চলে যাওয়ার পর প্রচুর পরিমাণে প্রোডাক্টটিভ হয়।’
Array