কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় বেশিরভাগ সময়ই পুড়ছে রোহিঙ্গাদের ঘর। অনেক সময় ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বড় ধরনের প্রাণহানি নজিরও রয়েছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আশ্রিত শিবিরে গত পাঁচবছরে ৩০০ শতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে হাজার হাজার ঘর পুড়েছে, নিঃস্ব হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। ঘুরেফিরে কেন ক্যাম্পেগুলোতে আগুন লাগছে, এর কারণ কী এমন নানা প্রশ্নও জেগেছে।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে আশ্রয় শিবিরে ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত। ৬০টি নাশকতামূলক ও ৬৩টির কারণ জানা যায়নি।
সর্বশেষ রবিবার (৫ মার্চ) বিকালে উখিয়া বালুখালীতে তিনটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা ঘটে। আগুনে দুই হাজার ঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। বিকাল ৩টার দিকে প্রথমে ১১ নম্বর ক্যাম্পের বি ও ই ব্লকে এই আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে পার্শ্ববর্তী ১০ ও ৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, ক্যাম্পে বারবার আগুনের পেছনে মিয়ানমারের বিচ্ছিনতাবাদী সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নাশকতামূলক তৎপরতা থাকতে পারে। ফলে সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।
এ বিষয়ে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা রফিক বলেন, ‘ক্যাম্পের বারবার আগুন লাগার পেছনে অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে। কিছু দিন যেতে না যেতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কেন ঘটে? আগের আগুনের ঘটনার তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘এতদিন ক্যাম্পগুলোতে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সম্প্রতি ক্যাম্পে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরনো সশস্ত্র সংগঠন আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) এর সদস্যরা। ফলে ক্যাম্পে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপরে মধ্য দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এর জেরে একপক্ষ আরেকপক্ষকে উচ্ছেদ এবং ফাঁসাতে শিবিরে আগুন দিতে পারে।’
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৮টি, ২০১৯ সালে ১০, ২০২১ সালে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যদিও সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে ২২২টি ছিল। ২০২০ সালে ঘটেছিল ৮২টি। যদিও রোহিঙ্গাদের হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি। এছাড়া চলতি বছর গত তিন মাসে ছোট-বড় ১৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
রবিবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২ হাজার পরিবারের ১২ হাজার মানুষের ঘর আগুনে পুড়ে গেছে। আগুন লাগার পেছনে নাশকতার অভিযোগে সন্দেহজনক স্থানীয় ১৭ বছরের এক কিশোরকে আটক করা হয়েছে।
জানতে চাইলে শরণার্থী ক্যাম্পে দায়িত্বে ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর বলেন, ‘আজ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর দৌঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে রোহিঙ্গারা এক কিশোরকে আটক করে। তাকে জিজ্ঞেসাবাদ চলছে।’
ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আগেও ঘটেছে উল্লেখ করে অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, ‘আগুন লাগার কারণে জানতে তদন্ত কমিটি করা হচ্ছে। আর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পেছনে অন্য কারণ আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখছি। পাশাপাশি ক্যাম্পে নজরদারি বৃদ্ধি করছি।’
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, প্রতি বছর শিবিরগুলোতে ৬০-৫০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও মাইকিং আর মহড়া ছাড়া সংশ্লিষ্টদের জোরালো ভূমিকা চোখে পড়ে না। শিবিরে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানোর তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনগুলোও আলোর মুখ দেখে না।
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উখিয়া স্টেশনের কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন, ‘আগের তুলনায় ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমেছে। তাছাড়া আগুন লাগার সঠিক কারণ জানাও কঠিন।’
তিনি বলেণ, ‘মূলত রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। সেখানে ঝুপড়ি ঘর আছে। তাই আগুন লাগলে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। বেশিরভাগ ক্যাম্পে প্রশস্ত রাস্তা না থাকায় ভেতরে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার পানির উৎসের সংকটও বেশি হওয়ার ফলে আগুন লাগলে শিবিরগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়।’
রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কোনো চক্রের হাত থাকার আশঙ্কা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ বের করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে সব সময়ই এখানকার মানুষের মাঝে আগুন লাগার ভীতি থাকবে। তাই এ ধরনের ঘটনা রোধে পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এর আগে রোহিঙ্গারা ব্লকে ব্লকে পাহারা বসিয়েছিল।’
এর আগে ২০২১ সালে ২২ মার্চ একই ক্যাম্পসহ পাশ্ববর্তী তিনটি ক্যাম্পে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় আগুনে ১০ হাজারেরও বেশি বসতঘর পুড়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা গৃহহারা হয়েছিল। এছাড়া দগ্ধ হয়ে দুই শিশুসহ ১৫ জন রোহিঙ্গা মারা যায়। ওই ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে ভবিষ্যতে ক্ষয়ক্ষতি ও জানমাল রক্ষায় ১৩ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা।
Array