নতুন করে নজরদারিতে আসা ব্যাংকগুলোর বিধিবদ্ধ নগদ জমা সংরক্ষণে (সিআরআর) ব্যর্থতা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগ করা এক পর্যবেক্ষক জানান, প্রতিদিনই দুর্বল ব্যাংকগুলোর সিআরআর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো বেশিরভাগ সময় সিআরআর তথ্য মেলাতে পারছে না। প্রতি ১৪ দিন পর নির্দিষ্ট ৪ শতাংশ সিআরআর সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করতে হচ্ছে। তবে ব্যাংকগুলো এখন যেভাবে নজরদারিতে রাখা হয়েছে তা আগামীতে অব্যাহত রাখলে দ্রুতই এসব ব্যাংক সংকট কাটিয়ে উঠবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
জানা গেছে, গত বছরের ১২ জুলাই দেশের ১২তম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন আব্দুর রউফ তালুকদার। গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়েই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পৃথকভাবে তদারকির উদ্যোগ নেন। গত ৩ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১০টি দুর্বল ব্যাংককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করা হবে। খেলাপি ঋণের মাত্রা, মূলধন পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত ও প্রভিশন তথা সঞ্চিতির পরিমাণ— এই চার সূচকের ভিত্তিতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই সময় দুর্বল ব্যাংকগুলোর নাম জানাননি গভর্নর।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্বল ব্যাংকগুলো মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক। এছাড়া বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল), পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক), আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নাম শোনা গেছে।
ইতোমধ্যে পাঁচটি ব্যাংকে সমন্বয়ক বসিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলো হলো- এবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকেও সমন্বয়ক রয়েছে। সব মিলিয়ে সমন্বয়ক আছে ৬ ব্যাংকে। এসব সমন্বয়করা ব্যাংকের সব নথিপত্র দেখতে ও তদারকি করতে পারবেন।
পর্যবেক্ষক দেওয়া হয় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে। এছাড়া বেনামি ঋণ ও নিয়োগ পদোন্নতিতে অনিয়মের কারণে সংকটে পড়া ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সম্প্রতি পর্যবেক্ষক বসানো হয়েছে। সব মিলিয়ে পর্যবেক্ষক দেওয়া আছে আট ব্যাংকে। সমন্বয়ক ও পর্যবেক্ষকরা ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করবেন এবং বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও অনিয়মের ঘটনা তুলে ধরবেন। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নীতিমালা ও ঋণ নিয়মাচারের পূর্ণাঙ্গ পরিপালন নিশ্চিত করতে সবাইকে কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেন গভর্নর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের ঋণ অনিয়মের তথ্য এসেছে। নিয়ম অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে বড় কোনো অনিয়মের অভিযোগ থাকে তাহলে তা তদারকির জন্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ দুই ব্যাংকেও পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি ১৪ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক বসানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, নিবিড় তত্ত্বাবধান শুরু হতে যাওয়া এসব ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংটির বিতরণ করা মোট ঋণের ৯৮ শতাংশই খেলাপি। টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা।
এরপরই রয়েছে পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৬৭ শতাংশ। ব্যাংকটির ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) ৮৮ দশমিক ৫৩ শতাংশের ঘরে। কিন্তু আইন অনুযায়ী, ব্যাংকের মোট আমানতের শতকরা ৮৭ টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে পারে না। এ ছাড়া ব্যাংটির মূলধন ঘাটতি ৪২৫ কোটি টাকা।
সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে, জনতা ব্যাংকের ২৮ ভাগই সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি হয়ে পড়েছে। টাকার অংকে যা ২০ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা। আর ৫৯৮ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে ব্যাংকটি। সেপ্টেম্বর শেষে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে জনতা ব্যাংক।
ন্যাশনাল ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ ১১ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। বিতরণ করা ঋণের যা ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৭ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ঋণ-আমানত অনুপাতের হার ৯২ দশমিক ৯ শতাংশ, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ বেশি।
সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। ২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি রয়েছে ব্যাংকটির। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ৭২৬ কোটি, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের সাড়ে ১৭ শতাংশ। এ মুহূর্তে ব্যাংকটির ৩ হাজার ১৩ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি এবং ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি রয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১৯ শতাংশের বেশি। ব্যাংকটির ৩ হাজার ৫২১ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি এবং ২ হাজার ৮৫১ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে। বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যা ৮ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। আর মূলধন ঘাটতি ২ হাজার কোটি টাকা।
এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যা ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ঋণ আমানত অনুপাতের হার প্রায় ৯৩ শতাংশ। ওয়ান ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২ শতাংশ। ব্যাংকটির ঋণ আমানত অনুপাতের হার প্রায় ৮৯ শতাংশ। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৩৪৪ কোটি টাকা। আর মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ২৭১ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে থাকা ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের মোট ঋণের ৮২ দশমিক ২০ শতাংশই খেলাপি। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৬৮০ কোটি টাকা। ব্যাংকটি মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ব্যাংকটির ঋণ আমানত অনুপাতের হার প্রায় ৯৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্য একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইসলামী ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী এ দুটি ব্যাংকই চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্প গ্রুপের মালিকানাধীন। সম্প্রতি গণমাধ্যমের সংবাদের কারণে তিন ইসলামী ব্যাংক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণেও বিষয়টি উঠে এসেছে। তাই ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে ব্যাংকটির ঋণের অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
নানা উপায়ে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকে সাত হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ও বাকি অর্থ সোশ্যাল ইসলামী ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে এসব ঋণ বের করা হয়, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ঋণ নিয়েছে। যেগুলো মূলত নামসর্বস্ব কোম্পানি। এ রকম নামসর্বস্ব দুই কোম্পানির নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া হয় দুই হাজার কোটি টাকা।
এদিকে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৩৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা অনুসন্ধানের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।