পকেটে টাকা নেই। সারাদিন না খাওয়া। বাবা ফোন দিলে জানান, মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছেন তিনি। অথচ ক্ষুধার যন্ত্রণায় পেটে বালিশ দিয়ে শুয়ে থাকেন অনেক শিক্ষার্থীই। অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এসব শিক্ষার্থী। ভাবেন লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশন ও অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চালাবেন নিজের খরচ। উচ্চ দ্রব্যমূল্যের মধ্য দিয়ে অনেকেই এভাবে তিনবেলা খাবারের অর্থ জোগাড় করতে পারলেও অনাহারে থাকতে হয় অনেক শিক্ষার্থীকে।
‘শিক্ষার পথে খাবার না হোক প্রতিবন্ধকতা’ এই লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে খাবার নিশ্চিত করতে কাজ করছে ‘উত্তরণ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।’ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের এই সংগঠনের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি আবাসিক হলে (সোহরাওয়ার্দী, আলাওল, প্রীতিলতা ও খালেদা জিয়া হল) খাতা রাখা হয়েছে। যেদিন যে শিক্ষার্থীর কাছে টাকা থাকবে না, সেদিন যে কোনো হলে রাখা উত্তরণের খাতায় স্বাক্ষর করে খাবার খেয়ে নিতে পারবেন।
উত্তরণ নামটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। এই প্রকল্পে যুক্ত হচ্ছেন মানবিক মানুষেরা। শুরুতে শুধু বিনামূল্যে খাবার নিশ্চিত করলেও বর্তমানে শীতবস্ত্র ও কম্বল বিতরণ করেছন শীতার্থ শিক্ষার্থীদের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হলের ৩২৯নং কক্ষ ও সোহরাওয়ার্দী হলের ১৫২নং কক্ষে কম্বল রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে সেখান থেকে কম্বল নিতে পারছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো শিক্ষার্থী।
‘উত্তরণ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়’-এর রূপকার যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নূরনবী রবিন আজকালের খবরকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি উন্নতির পর ক্যাম্পাস খুললে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অনলাইন পেজে প্রায় শিক্ষার্থীদের অনেক পোস্ট চোখে পড়ত। যেখানে শিক্ষার্থীরা দারিদ্র্যের কারণে না খেতে পারাসহ অনেক ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর ক্ষুধার জন্য লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটবে, এটা তো হতে পারে না।
রবিন জানান, না খেতে পেরে কষ্ট পাচ্ছেন, এটা দেখে তার খুব দুঃখ হয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট করেন, যারা টাকার অভাবে খেতে পারছেন না তারা যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একসঙ্গে খাবার ভাগ করে খেতে চান তিনি। নূরনবী রবিনের সেই পোস্ট দেখে অনেকেই যোগাযোগ করেন তার সঙ্গে। কেউ প্রয়োজনে আর কেউ কেউ তার উদ্যোগের প্রশংসা জানিয়ে তার সঙ্গে মানবতার সেবায় কাজ করার জন্য।
নূরনবী রবিন বলেন, আমার পোস্ট দেখে আমাদের বিভাগের (যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা) রেজাউল স্যার আমাকে কল করেন। আমার সঙ্গে খাবারের জন্য কেউ যোগাযোগ করলে তাকে জানাতে বলেন। তিনিও হেল্প করতে চান। তারপর ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের জাহিদ হাসান ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাহমুদুল ইসলাম মারুফ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারপর একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করি। আমরা মার্চ মাসের দিকে হলে খাতা রাখার ব্যবস্থা করি। এখন অনেকেই উত্তরণ থেকে খাবার খাচ্ছেন। গত ডিসেম্বর মাসে প্রায় ১৮ হাজার টাকা খাবারের বিল হয়।
রবিন জানান, তিনি ভাববেনি এতো এতো শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিতে পারবেন। তিনি ভেবেছিলেন ফেসবুকে পোস্ট দেবে অল্প যে কয়জন যোগাযোগ করে তাদের তিনি ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করবেন। তিনি আসলে ভাবেননি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এতোজন শিক্ষার্থী খেয়ে-না খেয়ে ক্লাস করতেন।
তিনি বলেন, আমি ভেবেছিলাম নিজের খরচের টাকা থেকে সবাইকে সাহায্য করব যতটুকু পারি। আর প্রয়োজনে আত্মীয়-স্বজনদের থেকেও নিতে পারব। এলাকায়ও কিছু সামাজিক কাজ করেছি। ভালো কাজে মানুষ সহযোগিতা করতে চায়। অর্থও দেয়। ফেসবুকে পোস্ট দেখে বা সংবাদ মাধ্যমে জানতে পেরে এখন অনেকেই আমাদের টাকা পাঠায়। আমরা সেসব টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীদের খরচ বহন করি।
কয়েকজন শিক্ষার্থী আজকালের খবরকে বলেন, উত্তরণ আমাদের ভরসার জায়গা। যখনই আমাদের কাছে টাকা থাকে না, আমরা হলে রাখা খাতায় স্বাক্ষর করে খাবার খাই। আগের মতো না খেয়ে থাকতে হয় না। না খেতে পাওয়ার ভয়টাও থাকে না মনের মধ্যে।
Array