কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদে এবার দানের টাকার পাহাড় জমেছে। আজ শনিবার (৭ জানুয়ারি) দান সিন্দুক খুলে রেকর্ড ২০ বস্তা টাকা পাওয়া গেছে। দান সিন্দুকের এসব টাকা গণনা করে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ চার কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা পাওয়া গেছে। দিনব্যাপী গণনার পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় দানের টাকার এই হিসাব পাওয়া যায়। বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা ছাড়াও বিভিন্ন বৈদেশিক মুদ্রা ও দান হিসেবে অনেক স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া গেছে। বৈদেশিক মুদ্রাও এবার বেশি পাওয়া গেছে। এর আগে গত বছরের পহেলা অক্টোবর সর্বশেষ যখন দান সিন্দুক খোলা হয়েছিলো, তখন দান সিন্দুক থেকে সর্বোচ্চ তিন কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার ৮৮২ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। এবার মাত্র ৯৬ দিনে পাগলা মসজিদের দানসিন্দুকে জমা পড়েছে চার কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা। সে হিসেবে প্রতিদিন মসজিদটির দানবাক্সে চার লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি টাকা দান হিসেবে জমা পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তিন মাস ৬দিন পর শনিবার সকাল ৯টায় জেলা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণের উপস্থিতিতে পাগলা মসজিদের ৮টি দান সিন্দুক খোলা হয়। তবে ৮টি দানসিন্দুকের মধ্যে ৬টি দান সিন্দুকই খোলার অন্তত ১৫দিন আগেই পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
দান সিন্দুক থেকে টাকা খুলে প্রথমে বস্তায় ভরা হয়। এবার বড় বস্তায় ২০ বস্তা টাকা হয়েছে, যা বস্তার হিসেবেও সর্বোচ্চ। এরপর শুরু হয় দিনব্যাপী টাকা গণনা। টাকা গণনায় মসজিদ মাদরাসার ১৩২ জন ছাত্র, রূপালী ব্যাংকের ৭০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ৩৪ জন মসজিদ মাদরাসার কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট ২৩৬ জন মানুষ অংশ নেন। এবার দান সিন্দুকের টাকা গণনার সময় অনেক চিঠি-পত্রও পাওয়া গেছে। সেসব চিঠিতে দানকারীরা নিজেদের মনের বাসনার কথা লিখে জানিয়েছেন।
কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এটিএম ফরহাদ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার সুলতানা রাজিয়া, অহনা জিন্নাত, শেখ জাবের আহমেদ, মোছা. নাবিলা ফেরদৌস, মো. মাহমুদুল হাসান ও রওশন কবির, পাগলা মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শওকত উদ্দীন ভূঞা, রূপালী ব্যংকের এজিএম মো. রফিকুল ইসলাম, পাগলা মসজিদ কমিটির সদস্য সিনিয়র সাংবাদিক সাইফুল হক মোল্লা প্রমুখ টাকা গণনার কাজ তদারকি করেন। এছাড়া ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান টাকা গণনার কাজ পরিদর্শন করেন। অন্যদিকে টাকা গণনার এই এলাহী কাণ্ড নিজ চোখে অবলোকন করতে শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ মসজিদে ছুটে যান।
পাগলা মসজিদের মালামাল সংরক্ষক মো. বিল্লাল হোসেন জানান, প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মসজিদের দান সিন্দুকগুলোতে নগদ টাকা-পয়সা ছাড়াও স্বর্ণালঙ্কার দান করেন। দানসিন্দুকে দান করা ছাড়াও মসজিদের নিলামঘরে প্রতিদিন মানুষ নানা ধরনের জিনিসপত্র দান করেন। এসবের মধ্যে রয়েছে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, ফল-ফলাদি, কোরআন শরীফ ইত্যাদি। নিলামঘরে প্রতিদিন এসব নিলামে বিক্রি করে দেয়া হয়।
পাগলা মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শওকত উদ্দীন ভূঞা জানান, সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ এ মসজিদে দান করেন। তাদের বিশ্বাস, এখানে দান করলে রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তির পাশাপাশি মনের বাসনা পূরণ হয়। এই বিশ্বাস থেকেই দূর-দূরান্তের মানুষও এখানে দান করতে ছুটে আসেন। দানের টাকা ব্যাংকে জমা করা হয়। এছাড়া ব্যাংকে জমা রাখা টাকার মুনাফা থেকে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ও অসহায় মানুষদের সহায়তাসহ জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হয়।
ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজ জানান, পাগলা মসজিদের দান সিন্দুক খুলে পাওয়া টাকাগুলো রূপালী ব্যাংকে জমা করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার পাগলা মসজিদের দান সিন্দুকে জমা পড়েছে।
ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, পাগলা মসজিদ মানুষের একটি আবেগের জায়গা। অনেক মানুষ এখানে তাদের ইচ্ছাপূরণের জন্য দান করেন। দানের টাকায় এখানে ছয়তলাবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্স হবে। এজন্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ১২টি টেন্ডার আমরা পেয়েছি। তাদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে পরবর্তী কাজ শুরু করে দিবো।
কিশোরগঞ্জ শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে পাগলা মসজিদ অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান। শহরের পশ্চিমে হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে মাত্র ১০ শতাংশ ভূমির ওপর এই মসজিদটি গড়ে উঠেছিল। সময়ের বিবর্তনে আজ এ মসজিদের পরিধির সাথে সাথে বেড়েছে এর খ্যাতি ও ঐতিহাসিক মূল্যও। মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি অত্যাধুনিক ধর্মীয় কমপ্লেক্স এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রসারিত হয়েছে মূল মসজিদ ভবন। দেশের অন্যতম আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত মসজিদটিকে পাগলা মসজিদ ইসলামী কমপ্লেক্স নামকরণ করা হয়েছে। এ মসজিদের আয় দিয়ে কমপ্লেক্সের বিশাল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মসজিদের আয় থেকে বিভিন্ন সেবামূলক খাতে অর্থ সাহায্য করা হয়।
Array