বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক টানাপোড়েন পরিস্থিতিতে কৃষি খাতের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) প্রণয়নেও তার প্রতিফলন দেখা গেছে। আরএডিপিতে কৃষি খাতের প্রকল্পের বরাদ্দে অগ্রাধিকার দিতে পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক শিল্প, বিদ্যুৎ খাত, দারিদ্র্য বিমোচনে সংশ্লিষ্ট এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুনর্বাসন সংক্রান্ত প্রকল্পের বরাদ্দেও অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দেশে দেশে মন্দা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশও এই শঙ্কা থেকে মুক্ত নয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্ভাব্য মন্দার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বারবার ফসল উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন। পাশাপাশি প্রকল্প গ্রহণ এবং অনুমোদনের জন্য কৃষি খাতের প্রকল্পগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকার জন্য উৎপাদন বাড়াতে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রাখার আহ্বানও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ রকম অবস্থায় প্রস্তুত করা হচ্ছে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি। যে কারণে কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সচিব মামুন-আল-রশীদ কালবেলাকে বলেন, যেহেতু বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো জরুরি। সেজন্য কৃষি খাতে জোর দেওয়া হচ্ছে। সংশোধিত এডিপিতে কৃষি খাতের নতুন এবং চলমান প্রকল্পে বরাদ্দ কমানো হবে না। প্রয়োজন হলে বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে কিছু নতুন প্রকল্প এসেছে এবং সেগুলো অনুমোদনের সুপারিশও করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ এবং স্বাস্থ্য খাতেও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। পরিকল্পনা সচিব জানান, বড় নির্মাণ প্রকল্পে গুরুত্ব কম দেওয়া হচ্ছে। আর কম সময়ে বাস্তবায়ন শেষ হবে—এমন প্রকল্পে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
এডিপির আকার কমানো হবে কিনা—জানতে চাইলে পরিকল্পনা সচিব বলেন, বরাদ্দ কমোনোর এখনই কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রস্তাব পাওয়ার পর যাচাই-বাছাই শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে প্রতিবছর যেহেতু আকার কিছুটা কমে, সে হিসেবে এবারও কিছুটা কমতে পারে। তবে সেটা সামান্য।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলো সরাসরি কৃষি খাতে সম্পৃক্ত। চলতি অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের ৮৭টি প্রকল্প এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত। এ বাবদ বাজেটে বরাদ্দ রয়েছে ৪ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্পের সঙ্গেও কৃষি খাতের সম্পৃক্ততা রয়েছে। সেচ, সার, বাজার উন্নয়ন, কৃষি শিল্প, কৃষিপণ্য সহজে আনা-নেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমেই এ খাতের উন্নয়ন হয়।
তবে বিশেষজ্ঞরা বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে থাকা প্রকল্পগুলোতে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, এডিপি সংশোধনের ক্ষেত্রে যে প্রকল্পগুলো শেষের দিকে, সেগুলো চালিয়ে যেতে হবে। যেগুলো শুরু হয়নি বা পরিকল্পনা স্তরে আছে, সেগুলো আগামী বছরের জন্য স্থগিত করে রাখতে হবে। যেসব প্রকল্প মাত্র শুরু হয়েছে বা কিছু টাকা ব্যয় হয়েছে, সেগুলোতে খরচ স্থগিত করে রাখতে হবে। একই সঙ্গে গুরুত্ব বিবেচনা করে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন না হলে ধীরে বাস্তবায়নের কৌশলে যেতে হবে। আর বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ কমানোর প্রয়োজন আছে। কারণ, ভর্তুকি বাবদ সরকারের ব্যয় বেড়েছে। এই বাড়তি খরচ সরকারকে রাজস্ব সংগ্রহের মাধ্যমে মেটাতে হবে। তা না হলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাবে। কিন্তু ঋণ করে এ মুহূর্তে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। এসব কারণে অবশ্যই এডিপিতে বরাদ্দ কমাতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ খাদ্যের মতো বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ সংকটও তৈরি করেছে। জ্বালানি তেলের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দেশব্যাপী সংকট দেখা দেয়। কলকারখানায় উৎপাদনও ব্যাহত হয়। এসব কারণে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্পের বরাদ্দে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সংশোধনের জন্য একটি নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে। নির্দেশিকা অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সংস্থার অধীনে চলমান ও নতুন উন্নয়ন প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থবছরের আরএডিপির বরাদ্দের প্রাথমিক চাহিদা পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগে আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে অথবা মার্চের প্রথম সপ্তাহে সংশোধিত এডিপি অনুমোদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আরএডিপি প্রণয়নের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, সম্পদের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে সংশোধিত এডিপিতে নতুন প্রকল্প নেওয়ার চেয়ে চলমান প্রকল্প শেষ করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া ধীরগতির প্রকল্প হতে বরাদ্দ কমিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন গতির প্রকল্পে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে। বেসরকারি উদ্যোগে বাস্তবায়নের সম্ভাবনা রয়েছে—এমন প্রকল্প আরএডিপিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা যাবে না।
শুধু অনুমোদিত প্রকল্প বরাদ্দসহ আরএডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। এডিপিতে বরাদ্দবিহীনভাবে সংযুক্ত অননুমোদিত নতুন প্রকল্পগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরএডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হবে না। এডিপিতে বরাদ্দবিহীনভাবে অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের মধ্যে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আরএডিপিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা যাবে না বলেও নির্দেশিকায় বলা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে এডিপি বাবদ ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ৫৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সব মিলিয়ে ১ হাজার ৪৯৬টি প্রকল্পে এই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এতে মোট ব্যয় হয়েছে ৪৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরের মূল বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। সংশোধন করে তা ২ লাখ ১৯ হাজার ৬০২ কোটি টাকা করা হয়। অর্থবছর শেষে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছিল মোট ২ লাখ ৩ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে সরকার উন্নয়ন ও পরিচালন বাজেট ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি নিয়েছে। অর্থবছরের শুরুতে উন্নয়ন প্রকল্পে উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন অগ্রাধিকার ঠিক করে বরাদ্দ করা অর্থ ছাড় করা হচ্ছে। উচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্পে বরাদ্দের শতভাগ এবং মধ্যম অগ্রাধিকার প্রকল্পে বরাদ্দে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ অর্থ ছাড় করা হচ্ছে। আর নিম্ন অগ্রাধিকারের প্রকল্পে অর্থ ছাড় স্থগিত রাখা হয়েছে।
Array