রাজধানীর ডেমরা থানা এলাকা থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের রপ্তানিযোগ্য চোরাই গার্মেন্টস পণ্যসহ সংঘবদ্ধ আন্তঃজেলা ডাকাতচক্রের মূলহোতাসহ ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
গ্রেপ্তাররা হলেন, তাওহিদুল কাউছার (৪২), মো. নাজিম (৩৫), মো. মাসুদ (৩৫), মো. দুলাল (৪৫), মিরাজ উদ্দিন (৩৩), আব্দুল আল মাসুদ (৩০) এবং সাইফুল ইসলাম (২২)।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে র্যাব-৪ এর একটি দল রাজধানীর ডেমরা থানাধীন একটি প্যাকেজিং ভবনের সামনে এবং ভবনের দ্বিতীয় তলায় অভিযান পরিচালনা করে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের চোরাইকৃত প্রায় ২৫০০০ পিস গার্মেন্টস সামগ্রী একটি কাভার্ড ভ্যানসহ তাদের গ্রেপ্তার করে।
শনিবার (২৪ ডিসেম্বর) দুপুরে র্যাব-৪ এর সহকারী পরিচালক এএসপি মাজহারুল ইসলাম জানান, অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর, উত্তরাসহ আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুরের বিভিন্ন ফ্যাক্টরি থেকে গার্মেন্টসের মালামাল বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করার উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়ার সময় পথে কিছু কাভার্ড ভ্যান থেকে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ দামি গার্মেন্টস মালামাল চুরি হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, অভিযোগের প্রেক্ষিতে ছায়া তদন্তের এক পর্যায়ে ফ্যাক্টরি থেকে মালামাল চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়ার সময় পথে কাভার্ড ভ্যান থামিয়ে গার্মেন্টস পণ্য চুরির খবরে গত রাতে র্যাব-৪ এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর ডেমরায় অভিযানে যায়। একটি প্যাকেজিং ভবনের সামনে এবং ভবনটির দ্বিতীয় তলায় অভিযান পরিচালনা করে চোরাইকৃত প্রায় ২৫০০০ পিস গার্মেন্টস সামগ্রী ও একটি কাভার্ড ভ্যানসহ সংঘবদ্ধ আন্তঃজেলা ডাকাতচক্রের মূলহোতাসহ ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইতোমধ্যে উদ্ধারকৃত গার্মেন্টস মালামালসমূহ সংশ্লিষ্ট পোশাক প্রস্তুতকারী সংস্থার কর্তৃপক্ষ তাদের বলে সনাক্ত করেছে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, আশুলিয়া ও গাজীপুর থেকে বিভিন্ন দেশে রপ্তানির গার্মেন্টস মালামাল চুরির ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত।
জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, তারা মালামাল পরিবহনে নিয়োজিত চালকদের সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে একটি দুর্ধর্ষ ডাকাত চক্র গঠন করে পরস্পর যোগসাজশে বিগত কয়েক বছর ধরে গার্মেন্টস মালামাল কাভার্ড ভ্যান থেকে ডাকাতি করে স্থানীয় মার্কেটে চোরাইপথে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে আসছিল।
প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ ধরনের কয়েকটি চক্র ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সক্রিয় রয়েছে এবং প্রতি বছর এসব চক্রের মাধ্যমে শত কোটি টাকা মূল্যের দেশি পোশাক চুরি হয়ে যাচ্ছে।
গ্রেপ্তার চক্রটি সাধারণত কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভারদের সাথে সখ্যতা তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার লোভ দেখানো ও ডাকাতির মালামাল বিক্রয়ের টাকার একটি অংশ দেওয়ার কথা বলে তাদেরকে রাজি করিয়ে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিকটবর্তী নির্জন এলাকার ভিতর কিংবা চক্রের সুবিধাজনক স্থানে কাভার্ড ভ্যান পার্কিং করাতো।
পরবর্তীতে কাভার্ড ভ্যানটিকে তাদের লোড-আনলোড পয়েন্টে নিয়ে আসলে বিশেষ কৌশলে কাভার্ড ভ্যানের সিলগালা তালা না খুলে কাভার্ড ভ্যানের পাশের ওয়ালের নাট-বল্টু খুলে প্রত্যেক কার্টুনের ভিতরে থাকা মালামালের ৩০-৪০ শতাংশ মালামাল রেখে আবার আগের মতোই সঠিকভাবে কার্টুন বাঁধাই করে কাভার্ড ভ্যানে লোড করে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে নিয়ে যেত, যাতে করে ফ্যাক্টরি মালিক ও বন্দর কর্তৃপক্ষের কেউ সন্দেহ না করতে পারে।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এ ডাকাতচক্রটি কার্টুনের মালামালের ওয়েট ঠিক রাখার জন্য যে পরিমাণের মালামাল কার্টুন থেকে চুরি করে সরিয়ে রাখে ঠিক সে ওজনের জুট কার্টুনের ভিতর মালামালের মাঝখানে দিয়ে কার্টুন প্যাকেট করে। যার ফলে বন্দরে স্ক্যানিং কিংবা ওয়েট মেশিনে কোনো ধরণের অনিয়ম ধরা পড়ে না। এছাড়াও মাঝে মাঝে তারা মালামালসহ সম্পূর্ণ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানও লুট করেছে বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।
গ্রেপ্তার তাওহীদুল কাউছার (৪২) বরিশাল জেলার উজিরপুর থানার যোগীকান্দা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে মিরপুর জুট পট্টি এবং উত্তরায় স্টকলটের ব্যবসা শুরু করার সময়ে বিভিন্ন চোরচক্রের কাছ থেকে গার্মেন্টসের লুণ্ঠিত মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ের একপর্যায়ে নিজে ও গ্রেপ্তার নাজিম, মাসুদ, দুলাল, মিরাজ, আব্দুল আল মাসুদ, সাইফুলসহ অজ্ঞাতনামা ৩/৪ জনকে নিয়ে একটি সক্রিয় আন্তঃজেলা ডাকাত চক্র তৈরি করেন। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় গার্মেন্টস পণ্য লুণ্ঠনের দায়ে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। গ্রেপ্তার নাজিম (৩৫) পেশায় একজন ড্রাইভার। ড্রাইভার হওয়ার সুবাদে গার্মেন্টস পণ্য পরিবহনের ড্রাইভারদের সাথে তার পরিচিতি ও সখ্যতা রয়েছে।
এদিকে, গ্রেপ্তার মিরাজ (৩৩) জব্দকৃত কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার এবং সেই মূলত কাভার্ড ভ্যানের সিলগালা তালা না খুলে কাভার্ড ভ্যানের পাশের ওয়ালের নাট-বল্টু খুলতে পারদর্শী। গ্রেপ্তার মাসুদ ও দুলাল মালামাল লুণ্ঠনের সময় গোডাউনের দায়িত্বে থাকতো যেখানে চোরাইকৃত মালামাল লোড-আনলোড করে রাখা হতো।
অপর গ্রেপ্তার আব্দুল আল মাসুদ ও সাইফুল গার্মেন্টস পণ্য লোডিং-আনলোডিং শ্রমিক হিসেবে এ চক্রে কাজ করতো। গ্রেপ্তারদের নামে বিভিন্ন থানায় গার্মেন্টস পণ্য চুরির একাধিক মামলা রয়েছে।
এএসপি মাজহারুল ইসলাম বলেন, এ সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্রটি গার্মেন্টস মালামাল চুরি করার ফলে বিদেশি ক্রেতা সঠিকভাবে ও সঠিক সময়ে মালামাল ডেলিভারি না পাওয়ার কারণে মালামালে মূল্য পরিশোধ করতো না এবং পরবর্তীতে ক্রেতারা ক্রয় আদেশ দিতো না। এছাড়াও সঠিক সময়ে বিদেশি ক্রেতাদের নিকট নির্ধারিত গার্মেন্টস পণ্যটি পৌঁছে না দেওয়ার ফলে বিদেশী ক্রেতাদের কাছ থেকে দেশি গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের ঘাটতি দেখা যায় যার কারণে দিন দিন বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পের ঐতিহ্য ও সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
Array