বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনের বিষয়গুলো নিয়ে বেশি আলোচনা না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সংকোচ রয়েছে বলে মনে করছেন সমাজ উন্নয়নকর্মীসহ সংগঠকরা।
তাদের অভিযোগ, শহরতলী থেকে দূরের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বইয়ে থাকা বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন, করণীয়, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, নিরাপত্তা কৌশল, যৌন হয়রানি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসহ প্রাসঙ্গিক আলোচনার অধ্যায় শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় না। অথচ শিক্ষার্থীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করতেই সরকার পাঠদানে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এছাড়া পারিবারিক সচেতনতার অভাব, সামাজিক কুসংস্কার ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে সংকীর্ণতা কিশোর-কিশোরীদের দৈহিক সুস্বাস্থ্য এবং মানসিক বিকাশে এখনো বাধা হয়ে আছে।
মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুরে রংপুর নগরীর দর্শনায় ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে আয়োজিত সংলাপ অনুষ্ঠানের আলোচনায় অতিথিরা এসব কথা বলেন। জেলা পর্যায়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ইস্যুতে যুব জনগোষ্ঠী, শিক্ষক, উন্নয়নকর্মী ও সাংবাদিকদের সাথে এই সংলাপ আয়োজন করে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচির ‘অধিকার এখানে, এখনই’-২ প্রকল্প।
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে স্বর্ণনারী এসোসিয়েশনের সভাপতি ও সমাজ উন্নয়নকর্মী মঞ্জুশ্রী সাহা বলেন, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বইয়ে বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন, করণীয়সহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরা আছে। কিন্তু আমাদের গ্রামাঞ্চেলের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেণিকক্ষে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয় না। বরং প্রয়োজনীয় এই বিষয়গুলো শিক্ষকরা কৌশলে এড়িয়ে যান। অথচ শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধু-বান্ধবসহ আমরা সকলে যদি বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করি তাহলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংকোচবোধ থাকবে না। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে।
কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক রফিকুল হক বলেন, বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনের সম্পর্কে পাঠ্যবই আছে। সরকারও চাইছে শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকেই তাদের যৌন ও প্রজনন সম্পর্কিত বিষয়গুলো জানুক। এটা জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই পাঠবইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে আগ্রহ নেই। কারণ এই বই থেকে শিক্ষার্থীদেরকে উত্তর দিতে হয় না। তারা বিনা পরীক্ষায় শারীরিক শিক্ষার নম্বর পেয়ে যাচ্ছেন। আমরাও তাদেরকে এভাবে পরীক্ষা ছাড়া নম্বর দিয়ে আসছি। এটা কম-বেশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র।
সাংবাদিক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, প্রত্যেক পরিবার থেকে সচেতনতার বার্তা ছড়াতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিভাবক সমাবেশ, যৌন স্বাস্থ্য ও প্রজনন সম্পর্কিত সেমিনার, বিষয় ভিত্তিক প্রতিযোগিতাসহ বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনের বিষয়গুলো নিয়ে একটু খোলামেলা আলোচনা বাড়াতে হবে। এটা সম্ভব হলে আমাদের আগামী প্রজন্মের ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ দৈহিক সুস্বাস্থ্য এবং মানসিক বিকাশ ঘটবে। তবে আগের চেয়ে বর্তমানে সচেতনতার প্রভাবে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে রংপুর সদর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা শিখা রানী রায় বলেন, সরকারসহ আমরা সবাই চাই আমাদের আগামী প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যত। তাদের সুন্দর বিকাশ এবং সুস্থ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটুট। এজন্য শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে আমাদের সবাইকে যায় যায় জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। আমরা আমাদের ছেলে-মেয়ে থেকে শুধু করে সব কিশোর-কিশোরীদেরকে যদি বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন করতে পারি তবে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশটা আরো সুন্দর ও সুস্থ হবে।
সংলাপে ব্র্যাকের জেলা সমন্বয়কারী একেএম জাহেদুল ইসলামের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন ইউনিয়ন সমাজকর্মী আকলিমা আক্তার, সাংবাদিক রেজাউল করিম জীবন, সংবাদ ও সংস্কৃতিকর্মী ফরহাদুজ্জামান ফারুক, ‘অধিকার এখানে, এখনই’ প্রকল্পের ডিস্ট্রিক্ট ইয়ুথ মবিলাইজার সোলায়মান মিয়া প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণে অনেক সময় নানারকম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকে। শিশু থেকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে হরমোনের প্রভাবে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ জানে না কোথায় গেলে তারা সেবা পেতে পারে। এ সময়ে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন সম্পর্কে সঠিক পরামর্শ ও ধারণা তাদেরকে চিন্তামুক্ত, স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবন যাপনে সহায়তা করতে পারে। প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা অনেকটা লজ্জাজনক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় সঠিক উৎস থেকে ধারণার অভাবে তারা অনেক ভুল তথ্য পায়, যা তাদের জন্য ক্ষতিকর।
অনুষ্ঠানে সচেতনতামূলক কার্টুন প্রদর্শন, সমন্বিত যৌনতা শিক্ষা ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক বর্তমান পরিস্থিতি আলোচনা করেন ‘অধিকার এখানে, এখনই’ প্রকল্পের এরিয়া কোঅর্ডিনেটর মাধুরী সূত্রধর। পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইয়ুথ রাকিবুল হাসান। সংলাপ পর্ব শেষে ৫ জন ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
Array