অবশেষে পুরোদমে ছাপা শুরু হয়েছে আগামী শিক্ষা বর্ষের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপা। এতো দিন ঢিমেতালে মাধ্যমিকে বই ছাপা চললেও প্রাথমিক স্তরের বই ছাপা বন্ধ ছিল। গত তিন দিন ধরে প্রাথমিক স্তরের বই ছাপা শুরু হয়েছে। তবে শিক্ষা বর্ষ শুরু হতে মাত্র ১৭ দিন বাকি থাকলেও এই সময়ের মধ্যে শতভাগ বই ছেপে মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানো নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, মাধ্যমিকের প্রায় ৭০ ভাগ বই চলে গেছে (উপজেলায়)। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭ কোটি বই ছাপা শেষ হয়েছে। এখন প্রাথমিকের বই ছাপায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তিন দিন ধরে প্রাথমিকের বই ছাপা শুরু হয়েছে। প্রাথমিকের বইয়ের সাইজ কিছুটা ছোট। এগুলো ছাপতে কম সময় লাগছে। তাছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও প্রাথমিক-দুই স্তরের বই ছাপার কাজ পেয়েছে তাদের প্রাথমিকের বই ছাপায় বেশি গুরুত্ব দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। কারণ মাধ্যমিকের কিছু বই ছাপতে কিছুটা দেরি হলেও সমস্যা নেই। নতুন বছরের শুরুতে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের সবাইকে নতুন বই দেওয়া হবে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপানো হবে। এর মধ্যে গত সোমবার পর্যন্ত প্রায় ১৩ কোটি বই ছেপে উপজেলা পর্যায়ে পাঠিয়েছে ছাপাখানা মালিকরা। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে বাকি আর ১৭ দিন। এই সময়ে আরো ১০/১২ কোটি বই উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো সম্ভব হতে পারে বলে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার অগ্রণী, লেটার অ্যান্ড কালার, ব্রাইট ও প্রমা, কাজল ব্রাদার্স, সরকার ও আনন্দ নামের ছাপাখানাগুলো সবচেয়ে বেশি বই ছাপার কাজ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো মোট বইয়ের প্রায় অর্ধেক ছাপার কাজ পেয়েছে। দুটি ছাপাখানার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, গত তিন দিন ধরে তারা প্রাথমিকের বই পুরোদমে ছাপা শুরু করেছেন। তারা আশা করছেন ৩১ ডিসেম্বরের আগে শতভাগ না হলেও বেশিরভাগ বই ছাপা শেষ করতে পারবেন।
জানতে চাইলে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, এনসিটিবিতে গত সপ্তাহে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ছাপাখানা মালিকদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রাথমিকের বই ছাপার বিল পরিশোধের জটিলতা নিরসন হয়েছে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে ছাপাখানাগুলো ডিপিইতে বিলের জন্য যাবে না। ডিপিই টাকা দেবে এনসিটিবিকে। আর এনসিটিবি ছাপাখানাগুলোকে বিল পরিশোধ করবে। ডিপিই ‘অন্যায়ভাবে’ ছাপাখানাগুলোর গত বছরের ‘জামানত’ আটকে রেখেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষামন্ত্রী জামানতের টাকা ছাড়ের নির্দেশ দিয়েছেন। এখন তারা বিলের বিষয়ে আশাবাদী।
শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সমঝোতার পর ছাপাখানাগুলো ‘পুরোপুরি’ কাজ শুরু করেছে জানিয়ে তোফায়েল খান বলেন, বৈঠকে পেপার মিলগুলোকেও ডাকা হয়েছিল, তারা আসেনি। অনেক কাগজ উৎপাদনকারী মিল চুক্তি অনুযায়ী আমাদের ঠিকমতো কাগজও সরবরাহ করছে না। এ বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন। কাগজ পাওয়া গেলে বই ছাপার কাজ আরো দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে। এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৭ কোটি বই ছাপা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বই রয়েছে প্রায় ২০ লাখ কপি। মাধ্যমিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরের।
ছাপাখানা মালিক ও এনসিটিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩৫ কোটি বই ছাপতে প্রায় এক লাখ টন কাগজ প্রয়োজন। কিন্তু ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, বিশ^ব্যাপী মূল্যস্ফীতি, গ্যাস সঙ্কট এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অভাবে এমনিতেই দেশে ভালোমানের কাগজের সঙ্কট প্রকট। কাগজের কাচামালের সঙ্কটের অজুহাতে বেশির ভাগ পেপার মিল কাগজের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বাজারে কাগজের সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে ছাপাখানা মালিকদের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে নিউজপ্রিন্ট কাগজের উৎপাদন বন্ধ রেখে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাগজ উৎপাদনে জোর দিতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমরা শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে কাগজ আমদানিতে সাত শতাংশ শুল্প মওকুফের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। দরপত্রের শর্তে উন্নতমানের অর্থাৎ ‘ভার্জিন পাল্পযুক্ত’ কাগজে বই ছাপার কথা বলা রয়েছে। প্রাথমিক স্তরের বই ৮০ শতাংশ জিএসএমের (গ্রাম/স্কয়ার মিটার) কাগজে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা বা ভার্জিন পাল্প থাকতে হয়। এই পাল্প ছাড়া কাগজে উজ্জ্বলতা ঠিকমতো আসে না বলে এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তোফায়েল খানের দাবি, দেশে এই মুহূর্তে মাত্র দুটি মিলে ৮০ জিএসএমের কাগজ উৎপাদন হয়। বাকি সব মিলই নিউজপ্রিন্টের মতো ৭০ জিএসএমের কাগজ উৎপাদন করছে। কিন্তু বেশি টাকা দিয়েও বাজারে ৭০ জিএসএমের কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে ছাপাখানাগুলোর কিছু করার নেই।
প্রসঙ্গত, গত বছরের প্রাথমিকের বই ছাপার বিল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে (ডিপিই) আটকে থাকায় প্রাথমিকের বই ছাপা বন্ধ রেখেছিল ছাপাখানাগুলো। এ সংকট সমধানের পর গত তিন দিন ধরে প্রাথমিক স্তরের বইও পুরোদমে ছাপা শুরু করেছে ছাপাখানা মালিকরা। এবার প্রাথমিকের মোট বই ছাপা হচ্ছে প্রায় ১০ কোটি। গত সোমবার পর্যন্ত মাত্র ২০ লাখ বই ছাপা হয়েছে।
Array