রক্তের সম্পর্কের বাইরে গিয়ে মানুষ প্রথম যে সম্পর্ক পাতায়, তা হল বন্ধুত্ব। শৈশবের একান্ত নিজস্ব সৃজন। প্রিয় বন্ধুকে আগলে রাখি আমরা প্রায় সারাজীবন। আর ‘বন্ধুত্ব’ এমন একটা শব্দ, যা আমাদের জীবনভর বিপদে-আপদে বাঁচায়। এই মেটাভার্সের যুগে এক আকাশভরা বন্ধুত্বের সংলাপে ‘দোস্তজী’ (Dostojee) নামক ছবি বুনেছেন নবীন পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায়। কী বাহুল্যবর্জি, অতি-নাটকীয়তাহীন ছবি, চুপ করে দেখতে হয়। বাংলার মাটি-জল-হাওয়া-রোদে একটু একটু করে সেঁচে নেওয়া ছবির প্রত্যেকটা ফ্রেম। কী অনাড়ম্বর কিন্তু অক্লান্ত উদ্যাপন এই আনন্দ-বিষাদ-মাখা জীবনের। ফলে ছবিটা দেখতে দেখতে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে আপনা হতেই ছড়িয়ে যায় ‘দোস্তজী’-ই-ই-ই ডাক।
একটা টিনের সুটকেস নিয়ে, রোজ একই ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাওয়া, বন্ধুর পাশে বসার যে আনন্দ, তা কতখানি তীব্র আর সৎ হতে পারে ‘দোস্তজী’ দেখায়। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা একটি গ্রামে দুই বালক পলাশ (আশিক শেখ) আর সফিকুল (আরিফ শেখ) পাশাপাশি বাড়িতে থাকে । একটা বেড়ার ব্যবধান দুই বাড়িতে। এক স্কুলে পড়ে ওরা। একসঙ্গে টেটো চেপে স্কুলে যায়। পলাশ একটু ভাল পড়াশোনায়। সফিকুল পড়ায় ফাঁকি দেয়। প্রায়ই মাস্টারের কানমলা খায়। ‘বচ্চন সাইকেল রিপেয়ারিং শপ’-এর সামনে দাঁড়ায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আর হাঁ করে দেখে নায়ককে। ছবি তুলতে গিয়ে নায়কের মতো পোজ দিয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে পলাশ কাঁচা, তাতে কী সফি আছে তো! অতি কষ্টে কেনা একটা ঘুড়ি নিয়ে আসে সফিকুল, লাটাই পলাশের। চেত্তা দিতে গিয়ে অঘটন! ‘তুমি আমার ঘুড়ি ভেঙে দিলে?’ ‘ভেঙে গেল যে। আমি তোমার সঙ্গে জীবনে কথা বলব না।’– মনে থেকে যায় দুই হরিহর আত্মার ঝগড়ার প্রেক্ষাপট। আরেকদিন বেঞ্চে বসে পলাশ, ক্লাসে ঢুকছে সফি। সুকটেস সমেত সরে গিয়ে পলাশ জায়গা করে। না, সফি দূরে গিয়ে বসে। অনবদ্য এই আড়ি পর্ব। কথা বলব না বললেই কি আর থাকা যায়? নতুন ঘুড়ি কেনার পয়সা জোগাড় করে পলাশ, বন্ধুর জন্য একবেলা হেঁটে স্কুলে গিয়ে।
এই অপাপবিদ্ধ ভালবাসা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। কারও কারও হৃদয়ের কোনও এক গোপনে আজও রাখা আছে এমন অনির্বাণ মুহূর্ত কিন্তু তা ঘুমিয়ে গেছে। পরিচালক প্রসূন ‘দোস্তজী’-র জার্নিতে আরও একবার স্মৃতির অতলে ফেরত পাঠালেন আমাদের। জসীমুদ্দিন, বিভূতিভূষণের লেখার আঘ্রাণ তুহিনের ফ্রেমে, প্রসূনের ভাবনায়। ছবিটা দেখতে গিয়ে পথের পাঁচালী, সহজ পাঠের গপ্পো কিংবা ভিলেজ রকস্টারের কথাও মনে পড়ে। বোঝা যায়, এই ঘরানার ছবির ঐতিহ্য এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন নবীন পরিচালক। একটা দৃশ্য ভোলা যায় না– মসজিদ তৈরির জন্য রাখা আছে বালি, সফি সেখান থেকে চুপিসারে বালি নিয়ে যায় পলাশের বাড়িতে ঝুলনের পাহাড় বানাবে বলে। কিংবা ‘খান সাউন্ড’-এর মাইক থেকে গ্রামের রাম-রাবণ পালার অনর্গল ঘোষণা। বন্ধুত্বের ছবিতে এমনভাবেই নীরব ভালবাসা বুনে দিতে হয়। হ্যাঁ, ছবির প্রেক্ষাপট বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তিনমাস পরে। ইদের দিনের সিমুই খাওয়ার দৃশ্যটিও স্মৃতিতে রয়ে যাবে। আর মন জুড়ে থাকবে জোনাকি ধরার মুহূর্ত, আলোর মুকুট পরা দু’টি বালক। যত কম কথা, তত মুখর দৃশ্য। ছবির পুরোটাই আনন্দ-মসৃণ নয়। বিষাদভেজা পরিসরগুলো এমন অভিঘাত রাখে যে কারও কারও রুমালে আষাঢ় নামে। গল্পটা আর ভাঙছি না। আমাদের বেঁচে থাকায় ভালবাসা, স্মৃতি, বিচ্ছেদের একটা ‘প্রাইসলেস’ অবদান আছে, সে প্রায় ঋতু পরিবর্তনের মতো ঘুরে ঘুরে আসে। এই ছবি সেই কথা আলগোছে বলে যায়। একটা নিটোল গল্পের চেয়েও পদ্মপাতায় ধরা জলের মতো এ ছবি, মুক্তোর মতো মুহূর্ত দিয়ে বোনা।
অভিনয় প্রসঙ্গে বলা যায়, এ ছবিতে কেউ অভিনয় করছেন মনে হয় না। আরিফ শেখ, আশিক শেখ তো ‘দোস্তজী’-ই! পলাশের মায়ের চরিত্রে জয়তী চক্রবর্তীর নীরব অভিব্যক্তি দুর্দান্ত। বোন জয়ার রোলে ছোট্ট হাসনুহানা বড় মিষ্টি। সফির দিদির চরিত্রে স্বাতীলেখা কুণ্ডুকে আর মাস্টারের ভূমিকায় অনুজয় চট্টোপাধ্যায়কে বেশ ভাল লাগে। সাত্যকী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুর ছবির মেজাজ ধরে রেখেছে আগাগোড়া। প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের সংবেদনশীল মন, তুহিন বিশ্বাসের নিখুঁত সিনেমাটোগ্রাফি এবং দলগত প্রচেষ্টার ফল এমন একটা বিশুদ্ধ সিনেমা। অবশ্যই প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখুন।
Array