মেইন প্রেস সেন্টার থেকে সবচেয়ে কাছের স্টেডিয়াম এডুকেশন সিটি। কাছের স্টেডিয়াম হলেও জ্যাম পেরিয়ে যেতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে। আজও এর ব্যতিক্রম হলো না। জ্যাম ঠেলে যখন অবশেষে ম্যাচ শুরুর ঠিক আগে স্টেডিয়ামের মিডিয়া ট্রিবিউনে পৌঁছানো গেল, সেখান থেকে দেখা মিলল গ্যালারির লাল উৎসবের। স্পেন আজ নীল জার্সি পড়লেও তাদের মূল জার্সি লাল। তবে এডুকেশন সিটির স্টেডিয়ামে লাল রঙটা ঠিক স্পেনের লাল নয়, মরক্কোর লালে লাল। ম্যাচে যা হতে যাচ্ছে, সেসব যেন ছিল তারই পূর্বাভাস! গোলশূন্য ম্যাচের পর পেনাল্টি শ্যুট আউটে যে মরক্কো ৩-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছে স্পেনকে!
গ্যালারির মতো মাঠেও মরক্কোর আধিপত্য। র্যাঙ্কিং, ঐতিহ্য, তারকা খেলোয়াড় সকল সূচকেই মরক্কো সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেনের চেয়ে ঢের পেছনে। মানসিক শক্তি ও টিম স্পিরিটই তাদের মূল শক্তি। এই দুইয়ে বলীয়ান হয়ে লুইস এনরিকের স্পেনের বিপক্ষে খেলেছে।
কোস্টারিকাকে সাত গোল দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করেছিল স্পেন। এরপর আর সেই স্পেনকে পাওয়া যায়নি। চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানির বিপক্ষে দুর্দান্ত লড়াই শেষে ড্র, এরপর জাপানের বিপক্ষে বসল হেরেই। সেই স্পেন আজকের ম্যাচের শুরুতেই ৭০ শতাংশের কাছাকাছি সময় নিয়ে রেখেছিল বলের নিয়ন্ত্রণ। বল দখল মোটে ২০ ভাগের একটু বেশি হলেও মরক্কোর ফুটবলাররা বিভ্রান্ত হননি। যথেষ্ট পরিণত ফুটবলই খেলেছেন দলটি।
দ্বিতীয়ার্ধে ঘড়ির কাটা যতই এগিয়ে যাচ্ছিল, কোচ লুইস এনরিকে কপালের চিন্তার ভাঁজ তখন ক্রমেই বাড়ছিল। এনরিকে গাভির বদলে মোরাতাকে নামান। ৭০-৭৫ মিনিটের মধ্যে তিন পরিবর্তন করেন। শেষ পনের মিনিট ২০১০ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা যথেষ্ট চেপে ধরেছিল আফ্রিকান দলকে। মরক্কোর দলটি যে সহজে ভেঙে পড়ার নয়, সেটা তখন প্রমাণিত হয়েছে আরও এক বার।
পাঁচ মিনিট ইনজুরি সময় দারুণ ফুটবল হয়েছে। মরক্কো গোলের সুযোগ পেয়েছিল। ফিনিশিং ব্যর্থতায় আর গোলটি হয়নি। ইনজুরি সময় শেষ হওয়ার এক মিনিট আগে বক্সের একটু বাইরে ফ্রি কিক পায় স্পেন। সেই ফ্রি কিকে স্পেন গোল পেয়েই যাচ্ছিল। বল গোললাইন অতিক্রম করার আগ মুহর্তে মরক্কোকান গোলরক্ষক হাত ছোঁয়ান। শেষ মিনিটে দুইটি কর্নার আদায় করে স্পেন। মরক্কোর ডিফেন্ডারদের দক্ষতায় অবশ্য সফল হয়নি একবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।
গতকাল ক্রোয়েশিয়া-জাপান ম্যাচের মতো আজকের এই ম্যাচও গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের শুরুতে মরক্কো দারুণ এক আক্রমণ রচনা করে। স্পেন রক্ষণ পরাস্ত হওয়া সেই আক্রমণ অফসাইডে বাতিল হয়। স্পেন অতিরিক্ত সময়েও বল দখল নিজেদের পায়েই রেখেছিল। পুরো ম্যাচে ৮০০ পাস খেলেছে এনরিকের দল, তবে পায়নি কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখা। ১০৪ মিনিটে দুর্দান্ত এক আক্রমণ রচনা করে মরক্কো। ডিফেন্স চেরা পাসে স্পেনের দুই ডিফেন্ডার পরাস্ত। মরক্কোর ফরোয়ার্ডের প্লেসিং কোনো মতো পা দিয়ে ঠেকান স্প্যানিশ গোলরক্ষক উনাই সিমন।
অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে দুই দলই গোলের সুযোগ পেয়েছিল। মরক্কোর আক্রমণগুলো কিছু ক্ষেত্রে নষ্ট নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিতে। অন্য দিকে স্পেন এই অর্ধে গোল না পাওয়ার জন্য ভাগ্যকেও দুষতে পারে। ১২০ মিনিট শেষ তিন মিনিট ইনজুরি সময় ছিল। সেই ইনজুরি সময়ে স্পেনের আক্রমণ একটি সাইড পোস্টে লেগে বাইরে যায়। ভাগ্য সঙ্গ দিয়েছে মরক্কোকেও। এর এক মিনিট আগে যে স্পেনের আক্রমণ ক্লিয়ার করতে গিয়ে প্রায় আত্মঘাতী গোল হজম করেই বসেছিল দলটি, ভাগ্য সঙ্গ না দিলে কি আর সেখান থেকে বেঁচে ফেরা যেত?
পেনাল্টি শ্যুটআউটেও মরক্কানদের সঙ্গ দিল সে সৌভাগ্যটা। পাবলো সারাবিয়ার শটটা গিয়ে প্রতিহত হয় ক্রসবারে। তবে এর আগে পরে মরক্কানদের দুই শট নিতে আসা আবদেলহামিদ সাবিরি আর হেকিম জিয়েখ ঠিকই বল জড়ান জালে, ২-০ গোলে এগিয়ে যায় মরক্কো। এরপর কার্লোস সোলেরের শট ঠেকিয়ে দেন মরক্কান গোলরক্ষক ইয়াশিন বনো।
এই পর্যায়ে স্পেনকে পরের রাউন্ডে যেতে হলে গোলরক্ষক উনাই সিমনকে ঠেকিয়ে দিতে হতো পরের সবগুলো শট, আর গোল করতে হতো নিজেদের শটগুলোয়। সিমন সেটা করেওছিলেন। বাদ্র বানুনের শটটা ঠিকঠাক ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। তবে তৃতীয় শট নিতে আসা সার্জিও বুসকেটস নিজের কাজটা সারতে পারেননি। সোলেরের মতো তার শটটাও ঠেকিয়ে দেন বনো। মরক্কোর চতুর্থ শট নিতে আসা আশরাফ হাকিমি লক্ষ্যভেদ করেন ঠিকই। আফ্রিকান দলটির জয় নিশ্চিত হয়ে যায় তখন। গ্যালারির মতো মাঠের লড়াইয়েও টিকে যায় মরক্কোর ‘লাল উৎসব’। ওদিকে স্পেন ডোবে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নেওয়ার বিষাদে।
Array