চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে বদলে যাবে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও পর্যটননগরী কক্সবাজারের চিত্র। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। পর্যটননগরী কক্সবাজারের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব কমবে ৪০ কিলোমিটার।
শনিবার (২৬ নভেম্বর) টানেলের দক্ষিণ টিউবের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে টানেলের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। চীনের কাছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ঋণ প্রস্তাবের সেই গল্প জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রস্তাবটা তারা (চীন) প্রথম দিকে গ্রহণ করতে চায়নি। একটু সমস্যা ছিল। চীন সফরে গিয়ে আমি খাবার টেবিলে খেতে খেতে চীনের প্রধানমন্ত্রীকে আবারো এই প্রস্তাবটা দেই। তিনি খাওয়ার টেবিলেই রাজি হয়ে যান। আমাদের টিমের সদস্যরা খাবার না খেয়েই বের হয়ে গিয়ে (প্রস্তাব) রেডি করে। পরে এটির চুক্তি স্বাক্ষর হয়। আমি তাদের কাছেও কৃতজ্ঞ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ওই সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ওই সময় সেতু বিভাগে কর্মরত কেউ খাবার শেষ করেনি। খাবার বাদ দিয়ে তারা উঠে চলে যান। আর চীনের কর্তৃপক্ষও চলে যায়। তারা সমস্ত পেপার রেডি করে। আমি অপেক্ষা করি। রাত ১২টার দিকেই আমার উপস্থিতিতে এ চুক্তি সই করা হয়।
এদিকে শনিবার টানেলের একটি টিউব উদ্বোধন করায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের নতুন দিগন্ত সূচিত হয়েছে। যদিও ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় কমেছে আরো আগেই। চার লেন চালু হওয়ার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যোগাযোগ স্বাচ্ছন্দ্য হয়েছে। তাতে উপকৃত হয়েছেন কক্সবাজারগামী যাত্রীরাও। তবে এখন কক্সবাজার যেতে হলে চট্টগ্রাম শহরের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আর তাতে অনেক সময় ব্যয় হয়। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল চালু হলে সেই দূরত্ব এবং সময় দুটোই কমবে। টানেল চালু হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমবে অন্তত ৪০ কিলোমিটার। সড়কপথে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ৪১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৬৪ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। তাই ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ পথ।
বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে ঢাকার যানবাহনগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট হয়ে বন্দর টোল রোডের সঙ্গে নির্মিত আউটার রিং রোড-পতেঙ্গা হয়ে কর্ণফুলী টানেল ব্যবহার করলে চট্টগ্রামের দিকে পথ কমবে প্রায় ১৫ কিলোমিটার। তা ছাড়া কর্ণফুলী টানেল হয়ে আনোয়ারা উপজেলার সিইউএফএল ঘাট-চাতরি চৌমুহনী-বাঁশখালী-পেকুয়ার মগনামা হয়ে সরাসরি কক্সবাজার সদরে যুক্ত হলে কক্সবাজারের দিকে সড়ক কমবে আরো প্রায় ৩০ কিলোমিটার।
সেতু বিভাগ জানায়, দুই টিউব সংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার। তিনটি সংযোগপথের (ক্রস প্যাসেজ) মাধ্যমে যুক্ত থাকবে এই দুই টিউব। বিপদকালে এক টিউব থেকে অন্য টিউবে যাতায়াতের জন্য এই ক্রস প্যাসেজগুলো ব্যবহৃত হবে। কিছুদূর পরপর টানেলের দেয়ালে এই ক্রস প্যাসেজের দূরত্বের নির্দেশনা লেখা আছে। টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য দুই দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ভেতরের ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার।
টানেলটি কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে পশ্চিম প্রান্তে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির কাছ থেকে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) এবং কর্ণফুলী সার কারখানার (কাফকো) মাঝখান দিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছেছে। মূল টানেলের সঙ্গে পতেঙ্গা প্রান্তে শূন্য দশমিক ৫৫০ কিলোমিটার এবং আনোয়ারা প্রান্তে চার দশমিক আট কিলোমিটারসহ মোট পাঁচ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে। এ ছাড়া আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ সড়কের সঙ্গে ৭২৭ মিটার উড়াল সড়ক রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন এবং ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন।
দেশের প্রথম এই টানেল নির্মিত হচ্ছে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায়। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন রয়েছে এই মেগা প্রকল্প। এখন চলছে টানেলের ভেতরে ফায়ার ফাইটিং, লাইটিং ও কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনার কাজ। পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছে প্রকল্পের গাড়িও। নদীর তলদেশে হওয়ায় যেকোনো সময় পানি জমতে পারে, এমন আশঙ্কায় টানেলের মধ্যে বসানো হচ্ছে ৫২টি সেচ পাম্প। সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
টানেলে নদীর তলদেশে স্থাপন করা দুটি টিউবের একটিতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে বিকল্প পথে গাড়ি চালানো যায়, সেটিরও কাজ চলছে। বাতি ও পাম্প স্থাপন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরির কাজও সমানতালে চলছে। এখন চলছে কর্ণফুলীর দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা অংশে টোল প্লাজা নির্মাণের কাজ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, টানেল চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এক ধাপ এগিয়ে যাবে। টানেলকে ঘিরে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরীর এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিচ্ছেন। সেখানে যেমন দেশীয় বিনিয়োগ থাকবে, তেমন থাকবে বিদেশি বিনিয়োগ। আর তার জন্য দরকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ আর বন্দর। এরসঙ্গে মাতারবাড়ির একটা সম্পর্ক আছে। এ ছাড়া ঢাকার সঙ্গে কক্সবাজার যাওয়ার দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমে যাচ্ছে। টানেলের মোট কাজ হয়েছে ৯৪ শতাংশের বেশি। এই টানেল উদ্বোধন হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে শূন্য দশমিক ১৬৬ ভাগ। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি আল্লাহর রহমতে প্রধানমন্ত্রী ভালো জায়গায় নিয়ে গেছেন। কোনোভাবে এটি দমানো সম্ভব না। অনেকে উদ্বিগ্ন ছিল যে, বাংলাদেশের কী হবে? বাংলাদেশে যখন আইএমএফ এসেছে, তখন তারা প্রতিটি সেক্টর পর্যালোচনা করে দেখেছে। যদি মার্কিং করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ পাবে ‘এ’ প্লাস। আর এটি একদিনে পায়নি। বিভিন্ন নীতি ও উন্নয়ন থেকে হয়েছে। আর তারা এতে ইমপ্রেসড হয়েছে।
টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনর রশীদ বলেন, এখন প্রতিটি সিস্টেম কাজ করছে আলাদাভাবে। এরপর এগুলো আমাদের কন্ট্রোল সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত হবে। পাবলিক ব্যবহারের জন্য আমাদের সবকিছু ঠিক করতে হবে। আর সবমিলিয়ে জানুয়ারির শেষ দিকে শেষ হবে বলে আশা করছি। তিনি আরো বলেন, আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল, আর সেগুলো আমরা অতিক্রম করেছি। প্রথম টিউব ১৭ মাস লাগলেও পরেরটা ১০ মাসে সম্পন্ন হয়েছে।
চীন অর্থায়নে রাজি হয় যেভাবে: টানেলে চীনের অর্থায়নের প্রসঙ্গ তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমার মনে আছে, ২০১৪ সালের সেই সোমবার, সেদিন আমরা যখন প্রথম এই টানেলের পরিকল্পনা করি, তখন চীনের একটা প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। তবে প্রথমে তারা এই টানেল করতে আগ্রহী ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর কনভেনশনাল ডিপ্লোম্যাসির বাইরে গিয়ে যেটা করেছেন সেটার বাস্তব প্রতিফলন হচ্ছে এই টানেল। সেসময়ের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, চীন আমাদের প্রথমে কথা দিলো, তারা টানেল করে দেওয়ার জন্য সবরকম ঋণ ও সহায়তা দেবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের জুলাই মাসের ফার্স্ট উইকে প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে যান। তখন ব্রিজ ডিভিশন থেকে আমাদের ইনডাক্ট করা হলো। আমরা যখম চীনে গেলাম, সব চুক্তিপত্র নিয়ে যেদিন সন্ধ্যায় মিটিং হবে, তার আগের দিন রাতে আমাদের জানানো হলো- চীনা সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই প্রজেক্টে তারা সহায়তা দিতে প্রস্তুত নন। এরপর আমরা রাত ১টা-২টা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে অনেক নেগোসিয়েশন করার পর ওনারা রাজি হলেন না। পরের দিন যখন ২টার সময় মিটিং শুরু হলো, তখন প্রধানমন্ত্রী বলার পর চাইনিজ সরকার বিনীতভাবে অসম্মতি প্রকাশ করলেন। প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকবার বলার পরেও তারা সম্মত হননি। এজন্য আমরা একটু মনোকষ্টে ছিলাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরবর্তী সময়ে ডিনারের সময় প্রধানমন্ত্রী একটা আনকনভেনশনাল ডিপ্লোমেটিক আলোচনা তুলে এই টানেলের বিষয়ে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চাইনিজ সরকার আমাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছে। যদি এইভাবে ফিরিয়ে দেয়, তাহলে ডিপ্লোমেটিক চ্যানেলে বা মানুষের মধ্যে কী ধরনের মনোভাব তৈরি হতে পারে সেটি উল্লেখ করেন তিনি (প্রধানমন্ত্রী)। আরো বলেন, আপনারাই আমাদের ইনভাইট করেছেন, আমরা আপনাদের কাছে চাইনি। তখন চীনা প্রাইম মিনিস্টার আমাদের ডাকলেন, আর সবাইকে ইন্সট্রাকশন দিলেন। ডাইনিং টেবিলেই চাইনিজ প্রাইম মিনিস্টার ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চাইনিজ কমার্স মিনিস্টার, ফাইন্যান্স মিনিস্টার এবং আমরা যখন আলোচনা শুরু করলাম, তখন প্রধানমন্ত্রীর কথায় চাইনিজ প্রাইম মিনিস্টার কনভিন্স হলেন। তখন তিনি ভোর ৪টায় একটি লেট নাইট ডিনার আহ্বান করলেন। যেখানে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথাও জানালেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী চাইনিজ প্রাইম মিনিস্টারকে বললেন, আপনার আসার দরকার নেই। আমার বড় স্যুইটে বড় ড্রইংরুম আছে, সেখানে বসেই চুক্তি স্বাক্ষর করে ফেলবো। পরে রাত ১২টায় প্রধানমন্ত্রীর রুমে বসে চাইনিজ কমার্স মিনিস্টার ও আমরা চুক্তিটা স্বাক্ষর করেছি। আর এখানে আনকনভেশনাল ডিপ্লোমেটিক এফোর্ট না থাকলে এটা কোনোভাবেই বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না। তিনি বলেন, রাত ১২টায় আমরা যখন চুক্তি স্বাক্ষর করে বের হয়ে যাই, তখন প্রধানমন্ত্রী আমাদের বললেন, তোমরা কোথায় যাচ্ছো। আমি বললাম স্যার (প্রধানমন্ত্রী), আমাদের তো কাজ শেষ। আমরা রুমে চলে যাচ্ছি। তখন তিনি বললেন, তোমরা কোথাও যাবে না। না খেয়ে আছো। টেবিলে ভাত, সবজি, ডাল, গরুর মাংস আছে, খেয়ে যাও। উনি এই বিষয়টিও খেয়াল করেছেন, আমরা কাজ করতে গিয়ে খেতে পারিনি, আসলেই আমরা অভুক্ত ছিলাম। এই যে এত বিপর্যয়ের মধ্যে, এত টেনশনের মধ্যেও আমাদের ব্যক্তিগত দিকগুলোও খেয়াল রেখেছেন, তা নাহলে এটা আসলে বাস্তবে রূপ নিতো না। এজন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।
Array