- সাতক্ষীরা প্রতিনিধি/
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায়া বসবাসকারী মানুষের নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের আঘাত এখন নিয়মিত ঘটনা।
অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সামান্য জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল নিমজ্জিত ও লবনাক্ত পানি বৃদ্ধি অব্যহত রয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন, জীবিকা, কৃষি, স্বাস্থ্যসহ সকল কিছুর উপর। আর যে কোন দুর্যোগের প্রথম শিকার হয়ে থাকে উপকূলের নারী ও কিশোরীরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি আঘাত হানে। এরমধ্যে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও নদী ভাঙন অন্যতম। আগে ১৫ কিংবা ২০ বছর পর পর বড় ধরনের কোন প্রাকৃতি দুর্যোগ দেখা যেত। কিন্তু এখন তা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ-২০১৫ এর তথ্য অনুযইয়ী বিগত ২৫ বছরে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় সংঘটনের হারের ক্রমবৃদ্ধি লক্ষণীয়। বিগত ১৬ বছরে (১৯৯১-২০০৬) মাত্র ৬টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও গত এক দশকে (২০০৭-২০২০) সিডর, আইলা, মহাসেন, কোমেন, রোয়ান, বুলবুল, আম্পান ও সিত্রাংসহ ১৪টি ঘূর্ণিঝড় ঘংঘঠিত হয়েছে।
ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে এসব ঘূর্ণিঝড়গুলোর আঘাত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তবতারই প্রতিফলন। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, নদীভাঙন, নদীতে পানির জোয়ার বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে হচ্ছে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার মানুষদের। আর এসব দুর্যোগে শিশু ও নারীরা বিভিন্ন রোগে আক্রন্ত হচ্ছেন। এতে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন জলবায়ু কর্মীরা। বিশেষ করে উপকূলের নারীরাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার পরবর্তী প্রভাবগুলোর বেশি শিকার হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, উপকূলীয় শ্যামনগরে দেখা দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ রূপ। প্রত্যন্ত এ অঞ্চলের নারীদের ঋতুস্রাবের সময় ব্যবহার করতে হয় লবনাক্ত পানি, পাশাপাশি যে কাপড় ব্যবহার করেন সেখানকার নারীরা সেটিও পরিষ্কার করতে হয় লবণাক্ত পানিতে। এসবের ভয়ে উপকূলীয় নারীরা পিরিয়ড বন্ধ করতে নিচ্ছেন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল। ফলে তারা চর্ম ও জরায়ুজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার সেই রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অকালে জরায়ু খুইয়ে সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারাচ্ছেন।
এখানেই শেষ হচ্ছে না তাদের দুর্বিষহ জীবনগাথা, এরপর শুরু হচ্ছে নানামুখী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়ানক যন্ত্রণা, যা বাকি জীবন একাই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এই নারীদের। স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকের আশঙ্কা, এভাবে দিনের পর দিন পিল খেলে নিয়মিত মাসিক বন্ধ, বন্ধ্যাত্বসহ জরায়ুর ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হতে পারে নারীরা।
মনগর উপজেলার কৈখালী গ্রামের গৃহবধূ খাদিজা বেগম। উপকূলীয় এই নারীর সমস্যা ছিল অনিয়মিত পিরিয়ড এবং তলপেটে ব্যথা। চিকিৎসার জন্য স্থানীয় এমআরএ ক্লিনিকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রভাষক ডা.আনিছুর রহমানকে দেখাতে গেলে তিনি খাদিজার একটি অঙ্গ ফেলে দেয়ার পরামর্শ দেন। গত বছরের ২৮ আগস্ট ওই বেসরকারি ক্লিনিকের ওটিতে নিয়ে ৩২ বছর বয়সী খাদিজা বেগমের শরীর থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি কেটে বাদ দেন সরকারি চিকিৎসক আনিছুর রহমান। উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের সুব্রত মন্ডলের স্ত্রী শেফালী মন্ডল। দিনমজুরের কাজ করেন শেফালী। দীর্ঘদিন থেকেই ভুগছেন জরায়ুর সমস্যায়। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের নারীদের সবচেয়ে বেশি জরায়ুর সমস্যা। আমরা লবণাক্ত পানিতে গোসল করি, কিন্তু পানিটা নিরাপদ নয়। তাই এই রোগ বাড়ছে। তিনি নিজেও রোগটিতে আক্রান্ত জানিয়ে বলেন, ইন্ডিয়া, খুলনাসহ অনেক জায়গায় চিকিৎসা নিয়েছি। পানিতে নেমে গোসল করতে পারি না, ডাক্তারের নিষেধ আছে, যতদিন বাঁচবো ততদিন পুকুরে গোসল করতে পারব না। এখনও এই অঞ্চলের নারীরা এই রোগে বেশি ভুগছে। এই দুই নারীর দেহ থেকে যে অঙ্গটি অবলীলায় কেটে ফেলা হলো, সেটি সাধারণ অঙ্গ নয়, মানুষ যেখানে জন্ম নেয় সেই মাতৃগর্ভ, যাকে বলা হয় জরায়ু।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মতো উপকূলীয় এলাকাগুলোতে নোনা পানির আগ্রাসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারীরা। সারাটা বছর তাদেরকে নোনা পানির সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতে হচ্ছে, বিশেষ করে জরায়ু সংক্রান্ত রোগে। কিন্তু মানবপ্রজাতির বংশবৃদ্ধির জন্য সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটি রোগাক্রান্ত হলে কোনো রকম চিকিৎসার উদ্যোগ না নিয়ে সরাসরি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন এ অঞ্চলের এক শ্রেণির চিকিৎসক। জরায়ু কাটলেই যে নারীরা ভালো থাকছেন, তাও নয়। কথা বলে জানা যায়, নানা রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
দুই সন্তানের মা রহিমা বেগম বলেন, ‘আগে তো মাসের কিছুদিন শুধু পেটে ব্যথা করতো। অপারেশনের পর এখন সারাক্ষণ গা দিয়ে দাহ ওঠে। কাটা জায়গায় জ্বালা-যন্ত্রণা করে। মনে হয়, পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি, তাহলে একটু আরাম পাব। জরায়ু অপারেশনের পর থেকেই প্রচন্ড রকম মাথা ও শরীর জ্বালায় ভুগছেন বলে জানান ৩০ বছর বয়সী আসমা বেগম। সংসারেও অশান্তি লেগে থাকে সারাক্ষণ। সংসার টেকানো দায় হয়ে গেছে। আসমা বেগমের মতো অনেকেই জানিয়েছেন, জরায়ু কেটে ফেলার পর চিকিৎসকরা জ্বালাপোড়া কমাতে আজীবনের জন্য ‘টিবোনর’ ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে বেশির ভাগ রোগীই বলেছেন, এক পাতা (১০টি ট্যাবলেট) টিবোনর কিনতে প্রায় ২০০ টাকা লাগে। যেখানে অভাব সবার নিত্যসঙ্গী, সেখানে সারা জীবন এই ওষুধ কিনে খাওয়া কিভাবে সম্ভব?
সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সুশীলন। সংহস্থাটির প্রকল্প প্রকৌশলী শামীম হাসান বলেন, বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব এবং গোসলসহ দৈনন্দিন কাজে অপরিচ্ছন্ন ও মাত্রাতিরিক্ত লোনা পানি ব্যবহারের কারণে তারা শুধু জরায়ু ও চর্মরোগেই ভুগছেন না, শিশু-কিশোরী-নারীরা লিউকোরিয়া, রক্তশূন্যতা, আমাশয়সহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগেও ভুগছেন। লবণাক্ত পানি ব্যবহারে খোলপেটুয়া গ্রামেই প্রায় দেড়শ’ শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। যাদের অনেকেই ছোট থেকেই লম্বা হয় না। মাথা ও পেট মোটা হয়ে যায়। ফলে শুরু থেকেই তারা নানা শারীরিক সমস্যা নিয়ে বড় হচ্ছে। পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের সাতক্ষীরা ইউনিটের সমন্বয়ক এস এম শাহীন আলম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন উপকূলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা কয়েক বছরের হিসাবে দেখেছি, আগের তুলনায় এখন নারীদের সমস্যাগুলো প্রকট আকার নিয়েছে। নারীদের জরায়ু ফেলে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। তারা প্রিগনেন্সিয়া নামের এক ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। লবণাক্ত পানিতে বাড়ছে জরায়ুজনিত রোগ দিন দিন উপকূলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া নারীদের মধ্যে গর্ভধারণের সংখ্যা কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, উপকূল এলাকার নারীদের মধ্যে গর্ভধারণের সংখ্যা কমে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে গর্ভপাতের পরিমাণও। অনেকের চুল পড়ে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে এসব অঞ্চলে। শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. ফাতেমা ইদ্রিস ইভা বলেন, মেয়েরা তাদের ঋতুস্রাব বন্ধের জন্য পিল খাচ্ছেন এমন খবর পেয়েছি। এ কারণে মাসিকের সমস্যাসহ নানাধরনের রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এসব ওষুধ খেলে হরমোনের যে কাজ করার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন রীতা রানী পাল বলেন, অল্প বয়সে জরায়ু কেটে ফেললে নারীদের হট ফ্লাস (হাত-পা ও শরীর জ্বালাপোড়া), অল্পতে মেজাজ উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হতেই থাকে। তিনি জানান, বছর খানিক আগে ২ হাজার ৬০০ নারীর ‘জরায়ুমুখ’ পরীক্ষা করানো হয়। তাদের মধ্যে ৫৮ জনের জরায়ুমুখে ক্যান্সারের পূর্বলক্ষণ দেখা দেয় এবং দু’জনের জরায়ুমুখে ক্যান্সার ধরা পড়ে। তবে লবণাক্ত ও দূষিত পানি ব্যবহার পানিবাহিত রোগের অন্যতম কারণ সেটা প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ে বাস্তবসম্মত গবেষণা প্রয়োজন।
Array