তিন কনফেডারেশনের অধীনে ১৩টি দল নিয়ে ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে প্রথমবার বসেছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর। প্রথম আসরের শিরোপা জিতেছিল স্বাগতিক উরুগুয়েই। এরপর গত ৯২ বছরে নানা সময়ে আসরের কাঠামোতে এসেছে পরিবর্তন। বেড়েছে দলের সংখ্যা। পরিধি আর জনপ্রিয়তার নিরিখে বিশ্বকাপ ফুটবলকে বলা হয় দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। আগের ২১টি আসর মিলিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল এখন পর্যন্ত উপহার দিয়েছে ৮ চ্যাম্পিয়ন দল। যার মধ্যে একাধিক শিরোপা জিতেছে ৬টি দল। তাই বলা চলে বিশ্বকাপে শিরোপার লড়াইটা মূলত অল্প কয়েকটা দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। বিশ্বকাপের প্রতিটি আসরে ফেবারিট তালিকায় তাদের নাম সবার আগে থাকে। এই বিশ্বকাপেও হট ফেবারিটের তালিকায় আছে তারা। আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি বা স্পেনের মতো দলগুলোও প্রতিবারের মতোই কাতারেও শিরোপার লড়াইয়ে পাচ্ছে ফেবারিটের তকমা। কখনো বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগালের মতো দলগুলোও আছে ফেবারিট তালিকায়। তাদের স্কোয়াডের শক্তিমত্তা, পারফরম্যান্স, ইতিহাস সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বকাপে দলগুলোর সম্ভাবনার দিকে আলোকপাত করা যাক।
কাতার বিশ্বকাপের হট ফেবারিট যারা:
অধিকাংশ ফুটবল পণ্ডিত, সাবেক খেলোয়াড় কিংবা বর্তমান খেলোয়াড়দের চোখে কাতার বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় দাবিদার তিন দল হচ্ছে- পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল ও দুবার করে বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স। ইনজুরি সমস্যা ও ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের বিশ্বকাপের সাম্প্রতিক আসরগুলোতে বাজে ফলের পরও ফ্রান্সকে শিরোপার বড় দাবিদার ভাবা হচ্ছে। অনেকের বিশ্বাস, ব্লুজের হাত ধরেই কাটবে চ্যাম্পিয়নদের ফাঁড়া।
যে কারণে ব্রাজিল জিততে পারে বিশ্বকাপ:
পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল সবশেষ শিরোপা জিতেছিল ২০০২ সালে কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপে। গত দুই দশকে বছরে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসর কোপা আমেরিকা কিংবা কনফেডারেশন কাপে দারুণ সফল হলেও বিশ্বকাপে বারবার ব্যর্থ হয়েছে সেলেকাওরা। রোনালদো-রিভালদোদের সেই শিরোপা উৎসবের ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও একবারও আর ফাইনাল খেলতে পারেনি সর্বোচ্চ আসরের চ্যাম্পিয়নরা। চার আসরে তিনবার কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা দলটি একবার খেলেছে সেমিফাইনাল।
ব্রাজিলকে শিরোপার সবচেয়ে বড় দাবিদার বলা হচ্ছে মূলত তাদের দুর্দান্ত স্কোয়াডের জন্য। সাম্প্রতিক সময়ের আসরগুলোর কোনটিতেই এতো দুর্দান্ত স্কোয়াড পায়নি হলুদ জার্সিধারীরা। গত এক দশকের অতিমাত্রায় নেইমারনির্ভরতা কাটিয়ে ব্রাজিল এখন তারকায় পরিপূর্ণ এক দল। ভিনিসিউস জুনিয়র, রাফিনিয়া, গ্যাব্রিয়েল জেসুস, মার্টিনেল্লি, অ্যান্টনি, রদ্রিগোদের নিয়ে তর্কসাপেক্ষে আসরের সেরা রক্ষণভাগ ব্রাজিলেরই। তাদের আক্রমণভাগ এতটাই শক্তিশালী যে, রবার্তো ফিরমিনো-কৌতিনিয়োর মতো পরীক্ষিত তারকাও জায়গা পায়নি স্কোয়াডে।
ব্রাজিলের মিডফিল্ডও যথেষ্ট শক্তিশালী। ক্যাসেমিরো, ফ্যাবিনিয়ো, ব্রুনো গুইমিরেস, ফ্রেড, প্রত্যেকেই ক্লাবের মিডফিল্ডের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। রক্ষণে আছেন থিয়াগো সিলভার মতো প্রজন্মসেরা মিডফিল্ডার, দানি আলভেসের মতো কিংবদন্তি, মার্কুইনিয়োস আর ব্রেমারের মতো পারফর্মার। গোলপোস্টের সামনে সময়ের সেরা আলিসন আর এডারসন তো আছেনই। তবে এতো কিছুর পরও এই ব্রাজিলের প্রাণ সেই নেইমারই। তিনিই এই দলের ধাঁধার সমাধান। বিশ্বকাপ জিততে হলে জ্বলে উঠতে হবে তাকে।
নেইমার অবশ্য আছেন দুর্দান্ত ফর্মের। বিগত বছরের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগী ফুটবল খেলছেন এবার তিনি। সেই সঙ্গে ফিটনেসও কথা বলছে পক্ষে। সব মিলিয়ে নেইমার থাকছেন এই বিশ্বকাপের ‘প্লেয়ার টু ওয়াচ’ এর তালিকায়।
ব্রাজিলের ফর্মটাও ভালোই যাচ্ছে। গত কোপার ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে হারের পর আর কোনো ম্যাচে হারেনি কোচ তিতের শিষ্যরা। আছে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে।
ব্রাজিলের কোচ তিতের সমালোচনা থাকলেও ট্যাক্টিশিয়ান হিসেবে তার সফলতা ঈর্ষনীয়। তার অধীনে ৭৬ ম্যাচ খেলে ৫৭টিতেই জয় পেয়েছে দল। ১৪টি ড্রয়ের পাশে হার মাত্র ৫টি। জয়ের হার ৭৫ শতাংশ!
শিরোপা জিততে হলে কিছু জায়গার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে হবে তাদের। সবার আগে ব্রাজিলের চিন্তার জায়গাটা তাদের রক্ষণভাগ। থিয়াগো সিলভা এখনো বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার হলেও তার বয়সটা হয়ে গেছে ৩৮। এই বয়সে প্রতি ম্যাচে সমান ভালো খেলা কঠিনই। বিশেষ করে টুর্নামেন্ট মাঝামাঝি গড়ানোর পরে ক্লান্ত পায়ে ইউরোপের গতিশীল আক্রমণভাগের বিপক্ষে তিনি কেমন করেন তার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছুই। বাকিদের মধ্যে মার্কুইনিয়োস কিংবা এডার মিলিতাও থাকছেন প্রথম পছন্দ হিসেবে। কিন্তু তারাও ভুল করেন যথেষ্ট।
ব্রাজিলের ফুটবলীয় গর্বের অন্যতম জায়গা তাদের ফুলব্যাকরা। অথচ ব্রাজিল দলে এবার মানসম্মত আক্রমণাত্মক ফুলব্যাকের নিদারুণ অভাব। যার কারণে দলে ফিরেছেন ৩৯ বছর বয়সী দানি আলভেজ। ব্রাজিলের প্রথাগত আক্রমণাত্মক ফুটবলে যা ঘটাতে পারে ব্যাঘাত।
চিন্তা আছে মিডফিল্ড নিয়েও। আছে মধ্যমাঠে সৃষ্টিশীল খেলোয়াড়ের অভাব। এই অভাব দূর করতে অবশ্য নেইমারকে খেলানো হতে পারে অ্যাটকিং মিডফিল্ডার হিসেবে।
ব্রাজিলের জন্য তিতের পরিকল্পনাও হতে পারে বুমেরাং। তার গৎবাঁধা একাদশ, বদলি খেলোয়াড় নামানোর ক্ষেত্রে পরিকল্পনার অভাব কিংবা তরুণদের ওপর ভরসার ঘাটতি ব্রাজিলের খেলায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
স্ক্যালোনির ঐক্যবদ্ধ আর্জেন্টিনা:
তুলনামূলক বিবেচনায় আর্জেন্টিনা দল এবার সবচেয়ে কম তারকাবহুল। লিওনেল মেসি-অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া কিংবা দিবালা-লাউতারো মার্টিনেজ ছাড়া খুব বড় তারকা নেই দলে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এমন ঐক্যবদ্ধ আর্জেন্টিনা দেখা যায়নি। স্ক্যালোনি আলবিসেলেস্তেদের দায়িত্ব নেওয়ার পর দলবদ্ধ হয়ে খেলার দিকে বেশি জোর দেন। মেসি নির্ভরতা কমিয়ে আর্জেন্টিনাকে দল হিসেবে খেলতে অনুপ্রাণিত করাটা স্ক্যালোনির বড় অবদান।
আর্জেন্টিনা দলের নিউক্লিয়াস এখনো মেসি। তবে মেসি এখন আগের চেয়ে অনেক নির্ভার। তার ছাপ পাওয়া যায় খেলাতেও। জাতীয় দলের হয়ে মেসি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি অপ্রতিরোধ্য।
আর্জেন্টিনার শক্তির জায়গা:
লিওনেল মেসি যে দলে খেলেন, তাকে ফেবারিটের তালিকায় রাখতেই হয়। তবে মেসি একাই এই আর্জেন্টিনার ত্রাতা নন, বরং দল হিসেবেই আর্জেন্টিনা দারুণ সব খেলোয়াড় নিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করছে। খুব বড় তারকা না হলেও বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই নিজেদের পজিশনে দুর্দান্ত পারফর্মার। গোলপোস্টের নিচে এমিলিয়ানো মার্টিনেজ ভরসা করার মতোই খেলোয়াড়। তার সামনে থাকা আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগ টুর্নামেন্টের সেরাদের একটা। ২০১৪ বিশ্বকাপের মতো এই বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনাকে বড় স্বপ্ন দেখাতে পারে এই রক্ষণভাগ। নিকলাস ওতামেন্ডি-ক্রিশ্চিয়ান রোমেরোর রক্ষণ চীনের প্রাচীরের মতোই দুর্দান্ত। বিকল্প হিসেবে লিসান্দ্রো আছেন লিসান্দ্রো মার্টিনেজ, যাকে ব্যবহার করা সম্ভব ফুলব্যাক কিংবা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। ফুলব্যাক হিসেবে থাকা নিকলাস ট্যাগলিয়াফিকো, মার্কোস অ্যাকুনা, হুয়ান ফয়থও ধারাবাহিক। স্ক্যালোনির দলের সাম্প্রতিক সফলতার অন্যতম বড় কৃতিত্ব দলটার নিশ্ছিদ্র রক্ষণের।
রক্ষণের পাশাপাশি মধ্যমাঠও যথেষ্ট শক্তিশালী আলবিসেলেস্তেদের। জিওভান্নি লো সেলেসোর ইনজুরি বড় ধাক্কা হয়ে এলেও এখনো যথেষ্ট রসদ মজুদ আছে তাদের মধ্যভাগে। লিয়ান্দো পারাদেস, রদ্রিগো ডী পল মধ্যমাঠে থাকছেন অটোচয়েজ হিসেবে। এই দুজনের সঙ্গে তৃতীয় মিডফিল্ডার হিসেবে প্রয়োজন অনুযায়ী ম্যাকঅ্যালিস্টার, পাপু গোমেজ বা এনজো ফার্নান্দেজদের ব্যবহার করতে পারবেন স্ক্যালোনি।
ফরোয়ার্ড লাইনে অবশ্য আগের বিশ্বকাপগুলোর মতো তারকার ছড়াছড়ি নেই আর্জেন্টিনা দলে। লিওনেল মেসি- অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার বিকল্প বিশ্বফুটবলেই নেই। ভালো কিছু করতে হলে আকাশি সাদা জার্সিধারীরা চেয়ে থাকবে তাদের দিকেই। সঙ্গে আছেন লাউতারো মার্টিনেজের মতো দুর্দান্ত স্ট্রাইকার। নিকো গঞ্জালেজ, ইউলিয়ান আলভারেজ তো আছেনই।
কোচ স্ক্যালোনি অভিজ্ঞতায় পিছিয়ে থাকলেও দল গোছানোয় দিয়েছেন মুনশিয়ানার ছাপ। সেই সঙ্গে খেলোয়াড়দের পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে দারুণ কাজ করেছেন তিনি। যার ফলও পাচ্ছেন। ২০১৯ সালে কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে হারার পর টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত আলবিসেলেস্তেরা। এ সময়ে ঘুচেছে দীর্ঘ শিরোপাখরাও।
আর্জেন্টিনার দুশ্চিন্তার জায়গা হতে পারে আক্রমণভাগ। প্লে মেকারের ভূমিকায় মেসি যে বলগুলো বানিয়ে দেবেন তা কতটা নির্ভরযোগ্যতার সঙ্গে গোলে পরিণত করতে পারবেন লাউতারো কিংবা নিকো গঞ্জালেজরা সেটাই দেখার বিষয়। আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকারদের সুযোগ নষ্ট করার প্রবণতা ভোগাতে পারে তাদের। তবে আলবিসেলেস্তেদের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে জিওভান্নি লো সেলসোর ইনজুরি। স্ক্যালোনি মিডফিল্ডের এই অপরিহার্য সদস্যের জায়গা কীভাবে পূরণ করেন তা-ই দেখার বিষয়।
ফ্রান্সের আছে শিরোপা ধরে রাখার সুযোগ:
১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের হাত ধরেই এক অভিশাপের সূচনা। ১৯৯৮ এর চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স ২০০২ বিশ্বকাপে ফেবারিট হয়ে গিয়েও বিদায় নিয়েছিল গ্রুপ পর্ব থেকে। তারপর থেকে ২০০৬ সালে ব্রাজিল ছাড়া প্রতিটি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শিরোপা ধরে রাখার মিশনে পার হতে পারেনি গ্রুপ পর্ব। এবার ফ্রান্সের সামনে সুযোগ অভিশাপ কাটানোর।
ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের প্রতিটি পজিশনে দুর্দান্ত সব তারকা। সদা চোখে দলটার দুর্বলতা খুঁজে পাওয়াই কঠিন। আগের চেয়ে পরিণত কিলিয়ান এমবাপ্পে-উসমান দেম্বেলের সঙ্গে আছেন দলে ফেরা করিম বেনজেমা ও আন্তইনে গ্রিজমান।
ফ্রান্সের গত বিশ্বকাপ স্কোয়াডের বেশিরভাগ তারকাই আছেন কাতার বিশ্বকাপেও। মাঝখানের সময়ে দলে ফিরেছেন করিম বেনজেমা। রিয়াল মাদ্রিদের ৩৪ বছর বয়সী তারকা আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। সম্প্রতি জিতেছেন ব্যালন ডি’অর। ৬ বছর পর ফ্রান্স দলে ফিরে পারফরম্যান্সটাও দুর্দান্ত তার।
বেনজেমাই একমাত্র তারকা নন ফরাসিদের বিশ্বকাপ দলে। সময়ের অন্যতম সেরা তারকা ও গত বিশ্বকাপে আলোড়ন তোলা কিলিয়ান এমবাপ্পে এখন আরও পরিণত। আছেন শুয়েমিনি, কামাভিঙ্গা, উপামেকানে, ভারানে, কুন্দের মতো তারকারা।
ফ্রান্সের কোচ হিসেবে ডাগআউটে এবারও থাকছেন দিদিয়ের দেশাম। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের অধিনায়ক ছিলেন তিনিই। অধিনায়ক ও কোচ হিসেবে শিরোপা জেতা দ্বিতীয় ফুটবলার দেশাম। কড়া হেডমাস্টার হিসেবে পরিচিতি থাকা এই কোচ দল সামলাতে সিদ্ধহস্ত। সেই সঙ্গে দারুণ ট্যাক্টিশিয়ানও। দীর্ঘদিন থেকে একই দল সামলে আসায় দলটার নাড়িনক্ষত্র সব তার নখদর্পনে। ফ্রান্সের মতো তারকাবহুল দল পরিচালনায় যা তাকে আলাদা আত্মবিশ্বাস যোগাবে।
ফ্রান্সের বিশ্বকাপ স্বপ্নে বড় বাধা ইনজুরি। কাতার বিশ্বকাপে ইনজুরির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দল ফ্রান্সই। ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপ স্কোয়াডেই থাকতে পারেননি পল পগবা ও এনগোলো কান্তে। যা তাদের মধ্যমাঠের শক্তি হ্রাস করেছে মারাত্মকভবে। এখানেই থেমে নেই। স্কোয়াড ঘোষণার পর ইনজুরির কারণে নাম প্রত্যাহার করে নেন প্রেসনেল কিম্পেম্বের মতো ডিফেন্ডার। অনুশীলনের সময় সতীর্থের সঙ্গে বল দখলের লড়াইয়ে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গেছেন ক্রিস্টোফার এনকুনকু।
ইনজুরির কারণে ফ্রান্সের মধ্যমাঠের শক্তি কমেছে প্রচণ্ডভাভবে। সেই সঙ্গে হয়েছে অভিজ্ঞতাশূন্যও। বিশ্বকাপে ব্লুদের মিডফিল্ড সামলানোর ভার থাকছে অউরোলিয়ে শুয়েমিনি, এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গার মতো মাত্রই ক্যারিয়ার শুরু করা তরুণদের হাতে। অনভিজ্ঞতা বিশ্বকাপে ভোগাতে পারে তাদের।
ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সও তাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ। সবশেষ নেশন্স লিগে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে তারা। জয়ের আকাঙ্ক্ষার অভাব, স্বার্থপরতা ও তারকাদের ইগো সমস্যা ফ্রান্সকে ভোগাতে পারে।
তারকাবহুল ইংল্যান্ডের থাকছে সুযোগ:
সর্বশেষ দুটি বড় আসরে শিরোপার খুব কাছে গিয়েও খালি হাতে ফিরেছে ইংল্যান্ড ফুটবল দল। ২০১৮ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে হারের পর ২০২০ ইউরোতে ফাইনালে উঠেছিল হ্যারি কেইন-বুকায়ো সাকার দল। কিন্তু ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় থ্রি লায়নদের।
কাতারে অবশ্য ফেবারিটদের তালিকায় আছে ইংল্যান্ড। দুর্দান্ত এক স্কোয়াড নিয়ে কাতারে যাচ্ছে তারা। দলে তারকার ছড়াছড়ি। প্রতি পজিশনেই আছে বিশ্বসেরা তারকাদের ছড়াছড়ি। হ্যারি কেইন, ফিল ফোডেন, বুকায়ো সাকা, অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ড, জুড বেলিংহ্যামদের মতো তারকারা ইংল্যান্ডের স্বপ্নসারথি বিশ্বকাপে। আছে সাম্প্রতিক সময়ে বড় দুই টুর্নামেন্টে সেমিফাইনাল ও ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা। ইংল্যান্ডের প্রতিবন্ধকতা তাদের বড় আসরে তাদের ভেঙে পড়ার ইতিহাস।
কাতারে ইংল্যান্ড যাচ্ছে ইনজুরিমুক্ত স্কোয়াড নিয়ে। জেমস রিসে ছাড়া তেমন কাউকে ইনজুরির জন্য হারাতে হয়নি তাদের। ফ্রান্সের মতোই রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলা অধিকাংশ খেলোয়াড় থাকছেন কাতারেও। নতুন করে যোগ হওয়া বেলিংহ্যাম কিংবা কেলভিন ফিলিপসরাও পরীক্ষিত। স্কোয়াডে ব্যাকআপ হিসেবে প্রতিটি পজিশনে আছে বিশ্বমানের বিকল্প।
অনেকের মতেই ইংলিশদের শিরোপা মিশনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তাদের কোচ গ্যারেথ সাউথগেটের ট্যাকটিকস। দারুণ মিডফিল্ড ও আক্রমণভাগ থাকার পরও এই ইংলিশ কোচ রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে থাকেন। যার কারণে প্রতিভার ছড়াছড়ি থাকার পরও হ্যারি কেইন ছাড়া নিজেদের মেলে ধরতে পারেনি কেউই। যার প্রভাব পড়েছিল উয়েফা নেশন্স লিগে। ২০২২-২৩ মৌসুমে নিজেদের গ্রুপে কোনো ম্যাচ জিততে পারেনি ইংল্যান্ড। এমনকি স্পটকিক ছাড়া গোল পেতেও ভুগতে হয়েছে তাদের।
সোনালি প্রজন্মের বেলজিয়ামের শেষ সুযোগ:
এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি ব্রুইন, দ্রিস মোরতেন্স, থিবো কোর্তোয়া, রোমেলু লুকাকুদের সোনালি প্রজন্মের বেলজিয়ামের এটাই শেষ সুযোগ হিসেবে দেখছেন প্রায়শ ফুটবলবোদ্ধা। গত বিশ্বকাপে তৃতীয় হওয়া দলটা কাতার বিশ্বকাপে গিয়েছে প্রায় অপরিবর্তিত দল নিয়ে। নতুন করে যোগ হওয়া লিয়ান্দ্রো ট্রোসার্ডরা আরও গভীরতা বাড়িয়েছেন দলের। রবার্তো মার্টিনেজের মতো মাস্টার মাইন্ড কোচ বেলজিয়ামের ডাগআউটে।
রেড ডেভিল খ্যাত বেলজিয়ামের অবশ্য বড় টুর্নামেন্টে ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা নেই। যেটা পিছিয়ে দিচ্ছে তাদের। তাছাড়া এডেন হ্যাজার্ড বা লুকাকুরা পেরিয়ে এসেছেন ক্যারিয়ারের সেরা সময়।
জার্মানি-স্পেনের সম্ভাবনা:
বিশ্বফুটবলের দুই পরাশক্তি জার্মানি ও স্পেন সাম্প্রতিককালে কিছুটা খারাপ সময় পার করছে। সোনালি প্রজন্মের বিদায়ের পর নতুন প্রজন্মের স্পেন এখনো পুরোপুরি গুছিয়ে নিতে পারেনি তাদের। নেই বড় কোনো তারকাও। তবে প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের অভাব নেই মোটেই। পেদ্রি, গাভি, ফেরান তোরেস, আনসু ফাতিদের মতো তরুণদের সঙ্গে অভিজ্ঞ সার্জিও বুসকেটস, জর্দি আলবা, কোকেরা থাকছে কাতারে। মিডফিল্ড ও রক্ষণভাগ নিয়ে দুশ্চিন্তা না থাকলেও আক্রমণভাগ নিয়ে ভালোই দুশ্চিন্তা আছে লা রোজাদের। আলভারো মোরাতা ছাড়া বিশ্বস্ত কোন স্ট্রাইকার নেই স্পেনের স্কোয়াডে।
একই ঘটনা জার্মানির বেলাতেও। দুর্দান্ত মাঝমাঠ ও রক্ষণভাগ জার্মানির। উইংয়েও দুর্দান্ত। কিন্তু সুযোগগুলো কাজে লাগানোর মতো স্ট্রাইকার নেই জার্মানির। তবে জোশুইয়া কিমিখ, টমাস মুলার, সার্জ গ্যানাব্রি, জামাল মুসলিয়ারা থাকায় তাদেরও শিরোপার সম্ভাবনা দেখছেন কেউ কেউ। আর বড় টুর্নামেন্টে জার্মানিকে হিসেবে না রাখলে কী হতে পারে সেটা তো ২০০২ বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলেই দেখিয়ে দিয়েছে তারা।
হিসেবের বাইরে নেই নেদারল্যান্ডস ও পর্তুগালও:
এক বিশ্বকাপ বিরতি দিয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে ফিরেছে নেদারল্যান্ডস। ২০১০ এ ফাইনাল ও ২০১৪ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলা নেদারল্যান্ডস এই বিশ্বকাপে হতে পারে ডার্কহর্স। ভ্যান ডাইক, মেমফিস ডেপাই ছাড়া বড় তারকা না থাকলেও দুর্দান্ত একদল তরুণ আছে নেদারল্যান্ডসের স্কোয়াডে। সাম্প্রতিক সময়ে দলটার ফর্মও দারুণ। তিনবার ফাইনাল খেলেও হার দেখা দলটা এই বিশ্বকাপে টপ ফেবারিট লিস্টে না থাকলেও অঘটন ঘটিয়ে দিলে অবাক হওয়ার থাকবে না কিছুই।
নেদারল্যান্ডসের শক্তির জায়গা তাদের রক্ষণভাগ। ভ্যান ডাইক-ম্যাথিয়াস ডি লিখট থাকছেন রক্ষণের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে। মধ্যমাঠে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, কোডি গাকপোর মতো তারকারা।
নেদারল্যান্ডসের বিশ্বকাপ স্বপ্নে বাধা হতে পারে অনভিজ্ঞতা। দলটার বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের নেই কখনো বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা। অত্যন্ত তরুণ দলটির গুরুত্বপূর্ণ তারকা ভ্যান ডাইক ৩১ বছর বয়সে খেলতে চলেছেন ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপ।
কখনোই ফাইনালে না খেললেও পর্তুগালকে এবার রাখা হচ্ছে ফেবারিট তালিকায়। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তার শেষ বিশ্বকাপে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছেন একদল বিশ্বসেরা খেলোয়াড়। বিশ্বকাপে সেরা মিডফিল্ড তাদেরই। ব্রুনো ফার্নান্দেজ, বের্নার্দো সিলভা, ভিতিনিয়া, রুবেন নেভেসদের নিয়ে গঠিত মধ্যমাঠ পর্তুগিজদের শক্তির জায়গা। রক্ষণে আছেন ৩৯ বছর বয়সী অভিজ্ঞ পেপে ও সময়ের সেরাদের একজন রুবেন দিয়াস। আছেন নুনো মেন্ডেস, গুয়েরোরো, জোয়াও কান্সেলোর মতো ফুলব্যাকরা। তাই ক্যারিয়ার শেষের আগে রোনালদো দেখছেন বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার স্বপ্ন।
তবে স্বপ্নভঙ্গের সম্ভাবনাও কম নয়। ২০০২ বিশ্বকাপে সোনালি প্রজন্মের পর্তুগাল বিদায় নিয়েছিল গ্রুপ পর্ব থেকে। তারকাবহুল দল হয়েও পর্তুগাল অতিমাত্রায় রোনালদোনির্ভর ফুটবল খেলে। আর সাম্প্রতিককালে রোনালদোর ফর্ম তাদের শিরোপা স্বপ্নে প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।
Array