পৃথিবীর সবচাইতে সুখময় অনুভূতির অভিজ্ঞতা মানে সন্তান জন্মদানের সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন? তাহলে শুরু করুন পরিকল্পনা।
গর্ভধারনকালীন সুস্থতা নিশ্চিত ও একটি সুস্থ সন্তান জন্মদানের আগে নিচের এই বিষয়গুলো মাথায় রাখুন।
১. চিকিৎসকের পরামর্শ
বাচ্চা জন্মদানের জন্য আগেই আপনাকে একজন চিকিৎসক বা ধাত্রী ঠিক করে রাখতে বলছিনা। কিন্তু গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার আগে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বা পারিবারিক চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চেকাপ করে নিন। আপনার ব্যক্তিগত আর পারিবারিক রোগব্যাধির ইতিহাস, আপনার স্বাস্থ্যগত অবস্থা, কোনো ওষুধ খাচ্ছেন কিনা সেসব খতিয়ে দেখবেন চিকিৎসক। কিছু কিছু ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে যা বদলানোর প্রয়োজন হতে পারে।
আপনার চিকিৎসক আপনার স্বাস্থ্যগত অবস্থা বিবেচনা করে আপনার খাদ্যভ্যাস, ওজনগত অবস্থা, ব্যায়ামের প্রয়োজনীয়তা, মাল্টিভিটামিন গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা, ধূমপান এবং এলকোহল গ্রহণের অভ্যাস থাকলে তা বাদ দেওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা দেবেন। তাছাড়া রুবেলা ভাইরাস সংক্রমণ বা চিকেন পক্স ইত্যাদির প্রতিষেধক নেওয়া আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখবেন তিনি। কারো এজমা, ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া লাগবে কিনা তাও নির্ধারণ করতে পারবেন তিনি।
২. জিনগত সমস্যা পরীক্ষা
বাবা মায়ের কারো সিস্টিক ফিব্রোসিস, শিকলড কোষ ইত্যাদির মত রোগ আছে কিনা তা ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখবেন। কারণ, গর্ভের শিশুদের মাঝে এসব রোগ চলে আসার ঝুঁকি থাকে।
৩. ফলিক এসিড ও ভিটামিন-এ
গর্ভধারণের একমাস আগে থেকে এবং গর্ভধারনের পর প্রথম তিনমাস প্রতিদিন একটা করে সম্পূরক ফলিক এসিড (৪০০ মাইক্রোগ্রাম পরিমানের) খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ন। এতে করে আপনার শিশুর স্নায়ুতন্ত্রে স্পিনা বিফিডার মত সমস্যা নিয়ে জন্ম নেওয়ার আশংকা ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। আলাদা করে ফলিক এসিড ছাড়াও মাল্টি ভিটামিনও খেতে পারেন যেটিতে ৪শ মাইক্রোগ্রাম মাত্রার ফলিক এসিড আছে। আপনার মাল্টি ভিটামিনে ৭শ ৭০ মাইক্রোগ্রামের বেশি ভিটামিন এ আছে কিনা তাও খেয়াল রাখুন। কারণ, অতিরিক্ত পরিমান ভিটামিন এ গ্রহণ করলে জন্ম থেকেই শিশুর সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবে কোন সাপ্লিমেন্ট বা সম্পূরক দ্রব্যই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করা ঠিক না।
৪. মদ্যপান, ধূমপান ও নেশাদ্রব্য বাদ দেয়া
অনেক গবেষণাই দেখাচ্ছে উপরের একটি অভ্যাসও যদি আপনার থাকে তাহলে তা আপনার গর্ভজাত সন্তান মিসক্যারেজ হওয়া, সময়ের আগে শিশুর জন্ম, কম ওজন নিয়ে জন্ম ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও, টোব্যাকো বা তামাকজাত সামগ্রী মায়ের উর্বরতা ও পুরুষদের ক্ষেত্রে বীর্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। গবেষণা দেখাচ্ছে পরোক্ষ ধূমপানেও সন্তান জন্মদানে বাধা সৃষ্টি হয়। গর্ভধারণের আগে দিনে অল্প মাত্রায় মদ্যপান ক্ষতিকর না হলেও গর্ভধারণের পরে মদ্যপান থেকে দূরে থাকতেই বলছেন গবেষকরা। কারণ এটা গর্ভের শিশুর বেড়ে ওঠায় বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
এসব অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস ছেড়ে দেয়া কঠিন হতে পারে। গর্ভধারণের আগে তাই এসব বদভ্যাস দূর করতে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দ্বিধা করবেন না একদমই।
৫. স্বাস্থ্যকর খাবার
দুজনের পরিমাণ খাবার খেতে হবে তা নয়, তবে আপনাকে প্রচুর পরিমাণে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে যাতে গর্ভধারণের আগেই আপনার শরীরে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টি উপাদান জমা হয়।
দিনে অন্তত দুই কাপ ফল, আড়াই কাপ নানারকম সবজি, হোল গ্রেইন বা শস্যজাতীয় খাবার, উচ্চমাত্রার ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার (যেমন দুধ, কমলার রস, টকদই), ইত্যাদি খেতে শুরু করুন। তাছাড়া নানারকম প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার যেমন শিমের বিচি, বাদাম, সয় পণ্য, পোলট্রি এবং মাংসও খাওয়া প্রয়োজন।
৬. ক্যাফেইন কমান
এখনো সেভাবে কোন জরিপ বা গবেষণা হয়নি যে গর্ভাবস্থায় বা গর্ভধারণের আগে দিনে ঠিক কী পরিমাণ ক্যাফেইন দ্রব্য গ্রহণ করা যাবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন দিনে এ সময়ে খুব বেশি ক্যাফেইন গ্রহণ না করাই ভালো। কারণ, কিছু কিছু গবেষণা বলছে বেশি মাত্রায় ক্যাফেইন গ্রহণে গর্ভপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
দিনে ২শ মিলিগ্রাম এর মত কফি পান করা যায়। তবে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না যেন।
৭. ওজন ঠিকঠাক রাখতে হবে
গর্ভধারণের পূর্বে আপনার ওজন বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ঠিকঠাক রাখুন। কম বা বেশি দুটোই সুস্থ গর্ভধারণের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত ওজন যাদের তাদের জন্য গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদান উভয় ক্ষেত্রেই জটিলতা দেখা দেয়। আর যাদের ওজন কম তাদের ক্ষেত্রে কম ওজনের সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা থাকে। গর্ভধারণের পূর্বে নিরাপদ ওজন বজায় রাখতে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।
৮. মাছ খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হন
মাছ খেতে খুব পছন্দ করেন যদি, তাহলে এ ব্যপারে একটু নজর দিন। মাছে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড আপনার শিশুর চোখ আর মস্তিষ্কের গঠনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রোটিন, ভিটামিন ডি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান ছাড়াও মাছে ক্ষতিকর মার্কারিও থাকতে পারে। মোটামুটি সব গবেষকই গর্ভবতী নারীদের মাছ খাওয়ার উপকারিতা নিয়ে বললেও তারা মার্কারি আছে এমন মাছ এড়িয়ে চলতে বলেন। তাই মাছ খাওয়ার আগে একটু বিবেচনা করে কিনতে চেষ্টা করুন। পুষ্টিবিদের সাথে যোগাযোগ করে মাছ খাওয়াই ভালো হবে এসময়।
৯. উপযোগী ব্যায়ামের রুটিন
গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার সময়েই আপনাকে একটা ফিটনেস প্ল্যান সাজাতে হবে। এতে যেমন স্বাস্থ্যকর খাবার থাকবে তেমনি থাকবে নিয়মিত আধাঘণ্টার ব্যায়াম। ব্যায়াম হতে পারে হাঁটা, সাইকেল চালানো, ওয়েট ট্রেনিং ইত্যাদি। নমনীয় শরীর পেতে স্ট্রেচিং বা যোগব্যায়াম করতে পারেন। তবে গর্ভধারণের আগে বা গর্ভধারণের পরে যে ব্যায়ামই করবেন না কেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া করবেন না। যদি খুব বেশি চাপের মনে হয় দিনে ১০ থেকে ২০ মিনিট দিয়ে শুরু করুন। আর দিনের কর্মকান্ডে আরও বেশি সচলতা যোগ করুন। যেমন লিফটের বদলে দু একটা সিঁড়ি পায়ে হেটেই উঠুন। পার্কিং লটের আগেই গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে কিছুদূর হেঁটে যান। ঘরের টুকটাক কাজও করতে পারেন নিজেকে ফিট রাখতে।
১০. দন্ত চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট
গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার পর্যায়ে মুখের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা ভুলবেন না যেন। গর্ভাবস্থায় হরমোন পরিবর্তনের জন্য নানারকম মাড়ির রোগের কারণ হতে পারে। প্রোজেস্টোরেন ও ইস্ট্রোজেন হরমোনের উচ্চমাত্রার জন্য আপনার দাঁতে থাকা প্লাকে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটে মাড়ি ফোলা, লাল হয়ে যাওয়া বা ব্রাশ করার সময় রক্তক্ষরণের মত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ছয়মাসের মধ্যে দন্ত চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে থাকলে গর্ভধারণের আগেই যান ও দাঁতের পরীক্ষানিরীক্ষা করান।
১১. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা
পরিবারের একজন নতুন সদস্য পৃথিবীতে আনার আগে অবশ্যই নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করুন। আপনার সন্তানের একটি সুন্দর আর সুরক্ষিত জীবন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পরিমান টাকা পয়সা আছে কিনা তা হিসেব করে দেখা দরকার। শুধু তাই নয়, চিকিৎসক, হাসপাতাল বা ক্লিনিক, নিজের ও জন্মের পর শিশুর জন্য পুষ্টিকর খাবার, ওষুধপত্র, ধাত্রী এসবের খরচও মাথায় রাখুন। সবমিলিয়ে একটি সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখানোর আগে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ঠিকঠাক রাখা খুবই জরুরি।
১২. মানসিক স্বাস্থ্য বিবেচনা করুন
গর্ভাবস্থায় হরমোন পরিবর্তনের জন্য বা পারিপার্শ্বিক কারণে একজন মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য খুবই খারাপ যেতে পারে। পোস্ট পারটাম ডিপ্রেশন বা পিপিডির হার দিন দিন বেড়েই চলেছে বিশ্বব্যাপী। তাই গর্ভধারণের আগে মানসিক প্রস্তুতি খুবই দরকার। সবার আগে বিবেচনা করে দেখুন আপনি নিজের শরীরের মাঝে আরেকটা শরীর বহনের জন্য প্রস্তুত কিনা। তার জন্মের পরে তাকে আপনার পূর্ণ মনোযোগ ও সময় দিতে হবে। এসব বিষয়ে মানসিক প্রস্তুতি আগে থেকেই সেরে রাখুন। আপনার পরিবার মূলত আপনার স্বামীকেও এব্যপারে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। গর্ভাবস্থায় বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পেতে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বা প্রয়োজনে মানসিক রোগের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
১৩. সংক্রমণ এড়িয়ে চলুন
মনে রাখবেন মায়ের শরীরে কোন সংক্রামক রোগ থাকলে তা গর্ভস্থ শিশুর শরীরেও ছড়িয়ে পড়ার জোর সম্ভাবনা আছে। তাই এ ব্যপারে আগে থেকেই সচেতন হন। বাইরের খোলা দূষিত খাবার ভুলেও খাবেন না। এগুলোতে থাকা রোগ জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস আপনার নিজের ও শিশুর জন্য বিপদজনক হতে পারে। এছাড়াও চাষকরা মাছ, মাংস, সবজি যেগুলোতে নানা রাসায়নিক ব্যবহৃত হয় তা এড়িয়ে চলুন। কোন ধরণের টিকা বা প্রতিষেধকের প্রয়োজন হলে তা সেরে রাখুন।
১৪. পরিবেশগত ঝুঁকি
আপনার চারপাশের সব পরিবেশগত ঝুঁকি যে এড়িয়ে চলতে পারবেন তা নয়। তবে নিজের সাধ্যের মধ্যে সব চেষ্টাই করা দরকার। যেমন আপনার বাসা বা চাকরির জায়গায় যদি উচ্চমাত্রার রেডিয়েশনের ঝুঁকি থাকে তাহলে গর্ভধারণের আগেই জায়গা পরিবর্তন করুন বা সতর্কতা বজায় রাখুন। প্রয়োজনে মুখে মাস্ক পরুন। ঘরে মোটা পর্দা দিয়ে ধুলোবালি আটকান। পানি অবশ্যই ফুটিয়ে বা জীবানুমুক্ত করে খান।
১৫. আরও একবার ভেবে দেখুন
একটা সন্তান মানে কিন্তু আজীবনের দায়িত্ব। গর্ভধারণের আগে তাই আরও একবার ভেবে দেখুন এমন একটি বড় দায়িত্ব পালন করতে আপনি প্রস্তুত কিনা। নিজেকে এই প্রশ্নগুলো করে দেখুন আর উত্তর মেলান।
বাচ্চার যত্ন নেওয়া কিন্তু খুবই জটিল আর বড়ধরণের দায়িত্ব। তাই নিজের কাজকর্ম, পারিবারিক দায়িত্ব, নিজের যত্ন সবকিছু সামলে সন্তানের জন্য সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবেন কিনা তা ভেবে দেখুন। যদি আপনার সন্তান স্পেশাল নিডের হয় তাহলে তাকে কীভাবে দেখাশোনা করবেন সেটা ভেবে দেখুন।আপনার স্বামী বা সঙ্গি আপনার সন্তানের প্রতি সমান দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে আন্তরিক কিনা তা নিয়ে আলোচনা সেরে রাখুন।
আপনার আর আপনার স্বামীর ধর্মীয় বিশ্বাস আলাদা হয়ে থাকলে আপনার সন্তান কোন বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে তা নিয়ে আগেভাগেই আলোচনা করে রাখা উচিৎ।
১৬. গর্ভধারণের উপযোগী সময় বিবেচনা করুন
আপনি যদি কোন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকেন তাহলে গর্ভধারণের আগভাগে এ ব্যাপারে হিসেবনিকেশ করে সিদ্ধান্ত নিন। ঋতুস্রাবের তারিখ অনুযায়ী মাসের কোন সময়ে আপনার শরীর গর্ভধারণ করতে সক্ষম সেই হিসেব করে নিন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
১৭. অবশেষে সময় এসেছে গর্ভনিরোধক বাদ দেওয়ার
উপরের সব যদি ঠিক থাকে তাহলে এখনই সময় আপনার গর্ভনিরোধককে বিদায় জানানোর। কোন কোন মহিলার শরীর কনট্রাসেপ্টিভ বাদ দেওয়ার সাথে সাথেই ডিম্বাণু উৎপাদন শুরু করলেও অনেকের মাসখানেক সময়ও লাগতে পারে। কোন কোন স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসক গর্ভনিরোধক বাদ দেওয়ার পরে গর্ভধারণের আগে কয়েকটা পিরিয়ড হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন।
সন্তানকে গর্ভে ধারণ ও তাকে পৃথিবীতে আনা একজন নারীর জীবনের অন্যতম সুন্দর অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাকে সফল আর সুরক্ষিত করতে আগভাগেই পরিকল্পনা করে রাখুন।
Array