নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী এক বছরে ৩৫ জন সচিব অবসরে যাবেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব আছেন মোট ৭৬ জন। জনপ্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা বলছেন, মাত্র এক বছরে এত বেশিসংখ্যক সচিবের অবসরে যাওয়ার নজির প্রশাসনে নেই বললেই চলে। জাতীয় নির্বাচনের বছরে প্রশাসনে এ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় চিন্তিত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও।
নিয়ম মেনে পদোন্নতি না দেওয়া, জ্যেষ্ঠতার তালিকা অনুসরণ না করা, পদোন্নতি দেওয়ার জন্য নিযুক্ত শীর্ষ কমিটি-সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) অলিখিত বিধানের মাধ্যমে পছন্দের লোককে পদোন্নতি দেওয়া, প্রশাসন ক্যাডারের কোনো ব্যাচ থেকে কম, কোনো ব্যাচ থেকে বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ইত্যাদি কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
মন্ত্রিপরিষদসচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ ১১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব ডিসেম্বরের মধ্যে অবসরে যাচ্ছেন। আর আগামী বছর আরো ২৪ জন সচিব অবসরে যাবেন। ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগে সচিব পদে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বদল হবেন অন্তত ১৫ জন জেলা প্রশাসক (ডিসি)।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ ১১ সচিব পদে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের অষ্টম, নবম, দশম ও ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পাবেন। পাশাপাশি ১৩তম ব্যাচের অতিরিক্ত সচিব পদের কর্মকর্তারা শিগগির সচিব পদে পদোন্নতি পাবেন। এই ব্যাচটি ১৯৯৪ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় নিয়োগ পেয়েছিল। অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার সময় এ ব্যাচকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগ সময় বিবেচনায় পদোন্নতি পেয়ে সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে গত সেপ্টেম্বরে। বাকিরা এক বছর পর এই পদের যোগ্য হবেন।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একই সূত্র জানায়, ডিসেম্বরের মধ্যে যে ১৫ জেলায় ডিসি পদে নতুন পদায়ন হবে তাঁরা বিসিএস ২৪ ও ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। এই দুটি ব্যাচও বিএনপি-জামায়াত সরকারের শেষ সময়ে নিয়োগ পাওয়া।
সংবিধান অনুযায়ী, আগামী বছরের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। ফলে এ সময় যাঁরা সচিব ও ডিসি পদে নিয়োগ পাবেন তাঁদের বেশির ভাগ আগামী জাতীয় নির্বাচনের দায়িত্বে থাকবেন।
নির্বাচনকালীন সময়ে মন্ত্রিপরিষদসচিব ও জনপ্রশাসন সচিবের পদটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করেন ডিসি ও ইউএনওরা। ডিসিরা জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩১ ডিসেম্বর। ফলে নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ এ পদে নতুন সচিব কে হচ্ছেন এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। একইভাবে আলোচনায় আছে মন্ত্রিপরিষদসচিব কে হচ্ছেন তা নিয়েও।
জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম খান অবসরে যাবেন আগামী বছরের ৩১ মার্চ। ফলে নির্বাচনের আগে জননিরাপত্তা বিভাগে নতুন সচিব নিয়োগ দেওয়া হবে। জননিরাপত্তা বিভাগের অধীন কাজ করেন পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও কোস্ট গার্ড সদস্যরা।
এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, তথ্য ও সম্প্রচার, শিল্প, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) নতুন সচিব নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘একসঙ্গে এতসংখ্যক কর্মকর্তার অবসরে যাওয়ার ঘটনা আগে দেখিনি। নিয়মমাফিক পদোন্নতি না হওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনা পাশ কাটিয়ে জ্যেষ্ঠতা, মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দিলে এই সংকট দূর হবে। পদায়নেও স্বচ্ছতা আনতে হবে। ’
সাত ব্যাচের কর্মকর্তাদের নিয়ে চলছে বিশ্লষণ
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিসিএস অষ্টম ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগদান করেন ১৯৮৯ সালে। নবম ও দশম ব্যাচের কর্মকর্তারা ১৯৯১ সালে। এই তিন ব্যাচের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলার সময় ক্ষমতায় ছিলেন প্রায়ত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ছিলেন এস এম আল হোসেনী। সে সময় পিএসসির নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে খুব বড় প্রশ্ন ছিল না। ফলে মূলত মেধাবীরাই নিয়োগ পেতেন বলে মনে করেন জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা। শিক্ষাজীবনে কে কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থক ছিলেন এ নিয়ে বাছবিচার তখন এতটা হতো না। কিন্তু এর পরের সব সরকারের সময় নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী বা সমর্থক হিসেবে প্রচার বা প্রমাণের একটা চেষ্টা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
১১তম ব্যাচের কর্মকর্তারা ১৯৯৩ সালে এবং ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তারা ১৯৯৪ সালের নিয়োগ পেয়েছেন। ওই সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। তখন পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন বিএনপি ঘরানার শিক্ষাবিদ ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ও এস এম এ ফয়েজ। তাঁদের বাসায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের যাতায়াতও ছিল।
২৭ সেপ্টেম্বর বিসিএস ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত সচিব হওয়ার দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। ফলে সচিবের পদে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ১১ ও ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তারাই প্রাধান্য পাবেন।
এ অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে সচিব পদে নিয়োগের বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে যাচ্ছে সরকার। এবারের নিয়োগ বদলির ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও আদর্শগত অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে।
মন্ত্রিপরিষদসচিব পদে আলোচনায় যাঁরা
প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ হলো মন্ত্রিপরিষদসচিব। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের দ্বিতীয় দফা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৫ ডিসেম্বর। ফলে এ পদে নিয়োগ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
সাধারণত মন্ত্রিপরিষদসচিব হিসেবে প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই হিসেবে আলোচনায় আছেন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কবির বিন আনোয়ার, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মাহবুব হোসেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জিয়াউল হাসান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
কবির বিন আনোয়ার বিসিএস সপ্তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি এখন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) ছিলেন। তাঁর নাম মন্ত্রিপরিষদসচিব পদে আলোচনায় আসায় বরিশালের সিটি মেয়রের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের দ্বন্দ্বের সময় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে তাঁর দেওয়া বিবৃতিকে এখন অনেকে সামনে নিয়ে আসছেন। ওই বিবৃতিকে প্রশাসন ও রাজনীতিকদের মধ্যে বিরোধের প্রতীক হিসেবে অন্যরা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন।
এই পদে বাকি যে কজনের নাম আলোচনায় আছে তাঁরা অষ্টম ব্যাচের কর্মকর্তা। এর মধ্যে গোলাম মো. হাসিবুল আলম পটুয়াখালী জেলার ডিসি ছিলেন। অন্য কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরির অভিজ্ঞতা নেই।
নির্বাচনকালীন সময় মাঠ প্রশাসনকে সামাল দেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাই বর্তমান মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে আরেকবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না সচিবালয়কেন্দ্রিক সূত্রগুলো। খন্দকার আনোয়ার ১৯৮২ সালের বিসিএস বিশেষ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা।
মুখ্য সচিব পদে আলোচনায় যাঁরা
মন্ত্রিপরিষদসচিবের পর গুরুত্বপূর্ণ হলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব। এই পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন আহমদ কায়কাউস। তিনি বিশ্বব্যাংকের বর্তমান বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগ পেতে পারেন। বর্তমানে এ পদে আছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব শফিউল আলম। তাঁর মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
আহমদ কায়কাউস বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। আগামী ৩১ ডিসেম্বর তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
এ পদে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার নাম আলোচনায় আছে।
আরো যাঁরা অবসরে যাচ্ছেন
২ নভেম্বর অবসরে যাচ্ছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আলী আজম। তাঁকে চুক্তিভিত্তিক অন্য কোনো দপ্তরে নিয়োগ দেওয়ার গুঞ্জন আছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে বদলি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলে আলোচনা চলছে। গত বৃহস্পতিবার তাঁকে সচিব থেকে জ্যেষ্ঠ সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অতিরিক্ত সচিব থাকার সময় তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি (নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ) অনুবিভাগে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এরপর শূন্য হবে স্থানীয় সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের পদ। এ দুটি পদে নিয়োগের আলোচনায় আছেন ভূমি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের নাম। এ ছাড়া ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তারাও সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে এ দুটি পদে আসতে পারেন বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র মনে করছে।
একই দিন অবসরে যাচ্ছেন ছয়জন সচিব
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে অবসরে যাচ্ছেন ১১ জন সচিব। এর মধ্যে ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাবেন ছয়জন। তাঁরা হলেন বিপিএটিসির রেক্টর রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মামুন-আল রশীদ, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব সায়েদুল ইসলাম, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনসচিব মোকাম্মেল হোসেন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।
Array