নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্ব আমূল বদলে গেলেও গত কয়েক দশকেও সিলেবাস বদলায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অনেক বিষয়ের। রয়ে গেছে পুরোনো আমলের প্রশ্নরীতিও। শিক্ষার্থীদের দেখা যায় নোট আর শিট ফটোকপিতে ব্যস্ত। পুরোনো নোট মুখস্থ করেও পাওয়া যাচ্ছে প্রথম শ্রেণি।
বিশেষ করে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বেশ কয়েকটি বিভাগের পাঠ্যসূচি পর্যালোচনায় জানা গেছে, বাংলা, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস, আরবি, উর্দু, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, সংস্কৃত, পালি ও বুড্ডিস্ট স্টাডিজ, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি, দর্শন, ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির মতো বিভাগগুলোর পাঠসূচি ও শিখন পদ্ধতিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। বছরের পর বছর একই পদ্ধতিতে একই লেকচার দিয়ে যাচ্ছেন অনেক শিক্ষক। প্রশ্নের ধরন নিয়েও নেই তাদের মাথাব্যথা।
প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগের সিলেবাসে সংযোজন, বিয়োজন-বিয়োজন হলে সেটা সংশ্লিষ্ট বিভাগের ‘কমিটি অব কোর্সেস স্টাডিজ’ এ ওঠে। বিভাগের সব শিক্ষক সেই কমিটির সদস্য। এরপর সেটা একাডেমিক কমিটির মাধ্যমে অনুষদে যায়। এরপর সেটা ‘বোর্ড অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ’ হয়ে চূড়ান্তভাবে একাডেমিক কাউন্সিলে গিয়ে অনুমোদন পায়। তবে নতুন কোনো বিষয় চালু হলে তার সিলেবাসের অনুমোদন লাগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাঠ্যসূচি করতে এক বছর আগে সব বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিছু বিভাগ পাঠ্যসূচি ঢেলে সাজিয়েছে। সবার কাছ থেকে এখনো সাড়া পাওয়া যায়নি।’
শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সেমিস্টার পদ্ধতিতে বছরে দুটি ফাইনাল ও দুটি মিড-টার্ম হয় এসব বিভাগে। দু-একটি কোর্স ছাড়া এসব বিভাগের মিড-টার্ম ও সেমিস্টার ফাইনালে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হয়। এক বছর বাদ দিয়ে পড়লেই কমন পাওয়া যায়।
মিড-টার্মে দিতে হয় একটি প্রশ্নের উত্তর। এর জন্য সর্বোচ্চ তিনটি প্রশ্নের উত্তর পড়েন শিক্ষার্থীরা। অনেকে আবার একটি পড়েও কমন পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
সেমিস্টার ফাইনালে বিভাগভেদে তিনটি থেকে পাঁচটি বড় প্রশ্ন এবং কয়েকটি ছোট প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এসব পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বড় অংশই নির্ভর করে পুরোনো নোট-শিটের ওপর।
কলা অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা জানান, ‘ঢাবির অনেকেই আশা অনুযায়ী বিভাগ পায় না। এতে তাদের বড় একটা অংশ হতাশায় ভোগেন। তাদের লক্ষ্য থাকে কোনোমতে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা। নোট মুখস্থ করেই তারা পাস করার চেষ্টা করেন।’
জানা গেছে, এসব বিভাগে দুই ধরনের নোট-শিট পাওয়া যায়। কিছু শিট বিভাগের শিক্ষকরা তৈরি করেন। সেগুলো কলাভবনের পেছনের ছাউনির ফটোকপি দোকান থেকে টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীদের সংগ্রহ করতে হয়। এসব শিট অধ্যায় ধরে তৈরি করা হয়। অনেক সময় বাজারে বই পাওয়া যায় না বলে শিক্ষার্থীরা এ শিট কিনতে বাধ্য থাকেন।
এ বিষয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এটিএম শামসুজ্জোহা বলেন, শিক্ষকদের দেওয়া শিট অনুসরণে শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহের পেছনে কারণ হলো—প্রত্যেকটি বিভাগের মিশন ও ভিশনের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা খাপ খাওয়াতে পারছে না। বিভাগভিত্তিক পড়াশোনা বাদ দিয়ে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বিসিএসের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। বিসিএস ক্যাডার হলে প্রভাব, ক্ষমতাসহ অন্যান্য সুবিধার কথা ভেবে তারা সাবজেক্টিভ পড়া থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।
আরেক ধরনের নোট তৈরি করেন ক্লাসেরই কিছু শিক্ষার্থী। অনেকে পরীক্ষা শুরুর কিছুদিন আগে সেগুলো ফটোকপি করেন। এমনকি শুধু এ ধরনের নোট মুখস্থ করেও প্রথম শ্রেণি পাওয়া যায় জানিয়েছেন অনেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কেউ যখন একটা বিভাগে পড়াশোনা করে, তখন আশা করা হয় সেই বিষয়ে সেই শিক্ষার্থী অভিজ্ঞ হবে। তার জ্ঞান রাষ্ট্র ও সমাজের কাজে লাগবে। প্রথাগত পদ্ধতিতে কিছু বিষয় পড়ানো হয় এবং যেভাবে প্রশ্ন করা হয়, এতে উন্নয়ন হচ্ছে না। মুখস্থনির্ভর জ্ঞান-তথ্য হয়তো পাচ্ছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে চাহিদা, দায়িত্ব সেই জায়গায় একটা ব্যবধান থেকে যাচ্ছে।’
সংক্ষিপ্ত নন-মেজর : কয়েকটি বিভাগের পাঠ্যসূচি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আরবি বিভাগে আরবি সাহিত্য ও ব্যাকরণের পাশাপাশি নন-মেজর হিসেবে আছে বেসিক ও অ্যাডভান্সড ইংলিশ, মুসলিম দর্শন, বাংলাদেশ স্টাডিজ ১ম ও ২য় ভাগ, কম্পিউটার, সোশ্যাল রিসার্চ অ্যান্ড প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট।
বাংলা বিভাগে নন-মেজর কোর্স দুটি। বাংলা সাহিত্য ও ব্যাকরণের পাশাপাশি কেউ চাইলে সমাজবিজ্ঞান ও দর্শন পড়তে পারবে কিংবা ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য পড়া যাবে। আরেকটি নন-মেজর হলো ভাষাবিজ্ঞান।
Array