স্পোর্টস ডেস্ক:
বিশ্বকাপ ফুটবলে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে মুখিয়ে থাকেন প্রতিটি খেলোয়াড়ই। ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে নিজ দেশের প্রতিনিধি হওয়ার গর্ব অনুভব করতে কে না চায়! পরে টুর্নামেন্ট শেষে বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফি উঁচিয়ে ধরলে তো সেই গর্ব তো গৌরবে পরিণত হয়ে সোনায় সোহাগা।
দেশের হয়ে অন্তত একবার বিশ্বকাপ ফুটবলের ট্রফিটি ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন থাকে প্রতিটি খেলোয়াড়েরই। তবে খুব কম খেলোয়াড়েরই সেই সৌভাগ্য হয়। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসি, ইয়োহান ক্রুইফ, মিশেল প্লাতিনির মতো অনেক কিংবদন্তিরই বিশ্বকাপ শিরোপা ছুঁয়ে দেখার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি।
জাতীয় দলের হয়ে একবার বিশ্বকাপ শিরোপা জিততে পারাই অনেকের কাছে চাঁদ ছোঁয়ার মতো। সেখানে একাধিকবার বিশ্বকাপ ট্রফি জেতা তো চাঁদকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার মতোই। অর্জনটাও তাই নিঃসন্দেহে কঠিন এবং ইর্ষণীয় বটে। সংখ্যার দিকে তাকালেই তা বোঝা যাবে।
ফুটবলের বিশ্বমঞ্চের বিগত ২১টি আসরে এখন পর্যন্ত মোট ৪৪৫ জন খেলোয়াড় দেশের হয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছেন। তবে একাধিকবার বিশ্বকাপ জিততে পেরেছেন কেবলমাত্র ২১ জন খেলোয়াড়। চলুন তাহলে দেখে নিই কারা কারা সেই সৌভাগ্যবান ২১ জন-
পেলে (ব্রাজিল)
ক্যরিয়ারে চারটি বিশ্বকাপ খেলে ১২টি গোল করেছিলেন ব্রাজিলের পেলে। ১৯৫৮, ১৯৬২ এবং ১৯৭০ সালে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে তৎকালীন জুলেরিমে ট্রফিটা চিরতরে ব্রাজিলের করে নেওয়ার অন্যতম বড় কারিগর ছিলেন ফুটবলের কালো মালিক। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি আছে শুধু এই ব্রাজিলিয়ানেরই।
জিওভান্নি ফেরারি (ইতালি)
১৯৩৪ এবং ১৯৩৮ সালে প্রথম দল হিসেবে টানা দুবার বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি গড়ে ইতালি। ১৯৩৪ বিশ্বকাপে ইতালির পক্ষে ২টি গোল করেন এই মিডফিল্ডার। একটি শেষ ষোলোয় যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে এবং অন্যটি কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের বিপক্ষে। স্কোরারের দায়িত্বে না থাকলেও প্লে-মেকার হিসেবে ভূমিকা রেখে আজ্জুরিদের হয়ে ১৯৩৮ বিশ্বকাপ জেতেন তিনি।
গুইদো মাসেত্তি (ইতালি)
ইতালির হয়ে ১৯৩৪ এবং ১৯৩৮ সালে টানা দুবার বিশ্বকাপ জিতেছিলেন এই গোলরক্ষক। যদিও দুটি বিশ্বকাপে আজ্জুরিদের জার্সি গায়ে এক মিনিটও খেলেননি গুইদো মাসেত্তি।
জিউসেপ্পে মিয়াজ্জা (ইতালি)
১৯৩৪ বিশ্বকাপে ঘরের মাটিতে আয়োজিত বিশ্বকাপে ইতালির জার্সিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচে, কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের বিপক্ষে গোল করেন এই স্ট্রাইকার। চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে ফাইনালে গোল না করলেও ম্যাচসেরা এবং টুর্নামেন্টসেরা হয়েছিলেন তিনিই। ১৯৩৮ সালে মিয়াজ্জা ছিলেন ইতালির অধিনায়ক। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে গোল করে এবং ফাইনালে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে ৩টি গোলে অবদান রেখে যোগ্য নেতা হিসেবেই আজ্জুরিদের বিশ্বকাপ জেতান।
ইরালদো মনজেগ্লিও (ইতালি)
ইতালির ১৯৩৪ এবং ১৯৩৮ বিশ্বকাপ জয়ী দলের অংশ ছিলেন এই ডিফেন্ডার। শুধু তাই না, ওই দুই আসরেরই টিম অব দ্য টুর্নামেন্টে জায়গা পান ইতালির স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে বিতর্কিত হওয়া এই ফুলব্যাক।
হিলদেরালদো বেলিনি (ব্রাজিল)
১৯৫৮ এবং ১৯৬২ সালে টানা দুবার ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতেন এই ডিফেন্ডার। এর মধ্যে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে হিলদেরালদো বেলিনি ছিলেন নেতৃত্বে। ১৯৫৮ বিশ্বকাপ জয়ের পর ছবি তোলার জন্য তার ট্রফি উঁচিয়ে ধরার পোজ তো ফুটবল ইতিহাসেই আলাদা জায়গা পেয়েছে।
মারিও জাগালো (ব্রাজিল)
প্রথম ব্যক্তি হিসেবে খেলোয়াড় এবং কোচ দুই ভূমিকায় বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি গড়েছিলেন মারিও জাগালোই। খেলোয়াড় হিসেবে ব্রাজিলের হয়ে ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ বিশ্বকাপ জিতেছিলেন এই উইঙ্গার ফরোয়ার্ড।
দালমা সান্তোস (ব্রাজিল)
আন্তর্জতিক ফুটবলে জাতীয় দলের হয়ে ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত টানা চারটি বিশ্বকাপ খেলেছিলেন সান্তোস। এর মধ্যে ব্রাজিলের হয়ে ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ সালে বিশ্বকাপ জেতেন এই ডিফেন্ডার। সেই সঙ্গে ওই দুই আসরের টিম অব দ্য টুর্নামেন্টেও জায়গা করে নিয়েছিলেন এই রাইটব্যাক।
গিলমার (ব্রাজিল)
১৯৫৮ এবং ১৯৬২ সালে ব্রাজিলের টানা দুই বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন এই গোলরক্ষক। ওই দুই আসরে ব্রাজিলের গোলবার সামলানোর দায়িত্ব যে ছিল গিলমারেরই। টুর্নামেন্টের ইতিহাসে একমাত্র গোলরক্ষক হিসেবে টানা দুবার বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তিও রয়েছে শুধু তার দখলেই।
গারিঞ্চা (ব্রাজিল)
ফুটবল বিশ্বের কাছে গারিঞ্চা নামে পরিচিতি পাওয়া খেলোয়াড়ের আসল নাম ছিল ম্যানুয়েল ফ্রান্সিস্কো ডস সান্তোস। ড্রিবলিংয়ে অসামান্য নৈপুণ্যের কারণে ভীষণ জনপ্রিয়তা ছিল তার। ব্রাজিলকে ১৯৫৮ বিশ্বকাপ জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও পাদপ্রদীপের আলো চলে যায় পেলের ওপরে। তবে নকআউট পর্বে ৪ গোল করে এবং ৩টি গোলে সহায়তা করে সেলেসাওদের ১৯৬২ বিশ্বকাপ জিতিয়ে এবং নিজে টুর্নামেন্টসেরা হয়ে ঠিকই সেই আলো নিজের দিকে কেড়ে নেন এই রাইট উইঙ্গার।
মাউরো রামোস (ব্রাজিল)
ব্রাজিলের ১৯৫৮ বিশ্বকাপ জয়ী দলের অংশ থাকলেও সেবার মাউরো রামোস কোনো ম্যাচই খেলেননি। অবশেষে ১৯৬২ সালে ব্রাজিলের অধিনায়ক হিসেবেই বিশ্বকাপ অভিষেক হয় তার। এই ডিফেন্ডারের নেতৃত্বেই টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জেতে সেলেসাওরা।
নিল্টন সান্তোস (ব্রাজিল)
ব্রাজি্লের ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ বিশ্বকাপ জয়ী দলের এই সদস্য ছিলেন ১৯৫০ বিশ্বকাপের মারাকানা ট্র্যাজেডির সাক্ষী। পরে জাঁতীয় দলের হয়ে দুবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ নিয়ে সেই ক্ষতে প্রলেপ দিয়েছেন নিল্টন। ডিফেন্ডার হলেও ১৯৫৮ বিশ্বকাপে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে দুর্দান্ত নৈপুণ্যে একটি গোল করে আলাদা জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি।
ভাভা (ব্রাজিল)
ব্রাজিলের হয়ে ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ বিশ্বকাপে জেতার পথে দুই আসরে যথাক্রমে ৫টি এবং ৪টি গোল করেছিলেন তিনি। সতীর্থ গারিঞ্চার সঙ্গে ১৯৬২ বিশ্বকাপের যৌথ সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন ভাভা। শুধু তাই না, দুটি ফাইনালেই নামের পাশে গোল ছিল তার। ফলে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে দুটি বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করেন এই ফরোয়ার্ড।
পেপে (ব্রাজিল)
পেপে নামে পরিচিত হলেও তার আসল নাম ছিল জোসে ম্যাসিয়া। ব্রাজিলের হয়ে ১৯৫৮ আর ১৯৬২ সালে দুবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেলেও নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন তিনি। দুই আসরেই শুরুর একাদশে থাকার কথা থাকলেও দুবারই বিশ্বকাপ শুরুর আগমুহূর্তের চোটের কারণে দুই আসরের কোনো ম্যাচেই মাঠে নামা হয়নি এই লেফট উইঙ্গারের।
জিটো (ব্রাজিল)
আসল নাম জোসে এলি দে মিরান্ডা হলেও জিটো নামেই চিনতো সবাই। রিজার্ভ খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে গেলেও স্বীয় নৈপুণ্যে দিদির মিডফিল্ড সঙ্গী হিসেবে শুরুর একাদশে জায়গা করে নেন। পরে জিতে নেন বিশ্বকাপই। ১৯৬২ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে ফাইনালে গোল ব্রাজিলকে টানা দ্বিতীয়বার শিরোপা জেতাতে ভূমিকা রাখেন।
জোজিমো আলভেস (ব্রাজিল)
মূলত ডিফেন্ডার হলেও মিডফিল্ডারের ভূমিকায়ও মাঠে খেলতে পারতেন জোজিমো। এই বহুমুখিতার জন্য জায়গা পেয়েছিলেন ব্রাজিলের ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ বিশ্বকাপজয়ী দলেও।
দিদি (ব্রাজিল)
দিদি নামে পরিচিত হলেও তার আসল নাম ছিল ওয়ালডাইর পেরেইরা। একই সঙ্গে মিডফিল্ডার এবং ফরোয়ার্ড দুই ভূমিকায় খেলতে পারতেন তিনি। ব্রাজিলের হয়ে জিতেছন ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ বিশ্বকাপ। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে তো টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়েরই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান।
কার্লোস কাস্তিলহো (ব্রাজিল)
১৯৫৮ এবং ১৯৬২ সালে ব্রাজিলের হয়ে টানা দুবারের বিশ্বকাপ জিতেছিলেন কার্লোস কাস্তিলহো। যদিও এই গোলরক্ষকের তাতে কোনো ভূমিকাই ছিল না। ওই দুই বিশ্বকাপে যে সেলেসাওদের হয়ে তিনি কোনো ম্যাচেই নামেননি।
ড্যানিয়েল প্যাসারেল্লা (আর্জেন্টিনা)
এখন পর্যন্ত দুবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছে আর্জেন্টিনা। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৭৮ এবং ১৯৮৬ বিশ্বকাপজয়ী আলবিসেলেস্তে দলের সদস্য ছিলেন ড্যানিয়েল প্যাসারেলো। এর মধ্যে ১৯৭৮ বিশ্বকাপে তিনিই ছিলেন নেতৃত্বে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার স্কোয়াডে থাকলেও অধিনায়ক ডিয়েগো ম্যারাডোনা আর কোচ কার্লোস বিলার্দোর সঙ্গে শীতল সম্পর্কের কারণে বেঞ্চ গরম করেই বেশি সময় কেটেছিল এই ডিফেন্ডারের।
রোনালদো (ব্রাজিল)
ব্রাজিলের ১৯৯৪ আর ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ী দলের অংশ ছিলেন এই গোলশিকারী। যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় ১৯৯৪ বিশ্বকাপে অবশ্য সবগুলো ম্যাচ বেঞ্চে কাটানোয় দলের শিরোপাজয়ে ভূমিকা রাখতে পারেননি। তবে ২০০২ বিশ্বকাপে ৭ ম্যাচ খেলে ৮ গোল করে গোল্ডেন বুট জিতে সেলেসাওদের সর্বশেষ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ছিলেন ফেনোমেননই।