নিজস্ব প্রতিবেদক:
গ্যাস সংকট দ্রুত সমাধানে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি; সিএনজি, আবাসিক ও সার কারখানা থেকে গ্যাস শিল্পে সরবরাহের বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন শিল্পমালিকরা। রিজার্ভ সংকটের কারণে আপাতত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার ঝুঁকি সরকার নেবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
তিনি বলেন, “প্রতিমাসে স্পট মার্কেট থেকে ২০০ এমএমসিএফডি এলএনজি কিনতে ২০০ মিলিয়ন ডলার লাগবে। ছয় মাস এলএনজি কিনলে ব্যয় করতে হবে ১.২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা সেই জন্য আমরা এখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করার মতো রিস্ক নিতে পারব না। কারণ আমরা জানি না সামনে কি হবে। যদি আমরা জানতাম একটা জায়গায় এসে এলএনজির দাম স্থিতিশীল হবে তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। আমরা তা জানি না ভবিষ্যতে এলএনজির দাম কেমন হবে। আমরা জানি না রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ কত দিন চলবে।”
রবিবার (২৩ অক্টোবর) রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত সেমিনারে গ্যাস সংকট নিয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম পারভেজের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। বিশেষ অতিথি এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, “শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে গেলে অন্য খাতে কমাতে হবে। বিদ্যুৎ খাতে এখন যে পরিমাণ গ্যাস দেওয়া হয়, তার চেয়ে কম সরবরাহ করলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমবে। তখন লোডশেডিং বাড়বে। সবাই সাশ্রয়ী হলে কিছু গ্যাস সাশ্রয় করে শিল্পে দেওয়া যাবে।”
দিনে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের শপথ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, “যুদ্ধের সময় কিছুই ছিল না। কোনো খাওয়া ছিল না। এমনও দিন ছিল যখন রাতে আমরা বাতি দিয়ে থেকেছি। দিনের আলোয় সব কাজ করেছি। সাশ্রয়ী হতে গিয়ে কষ্ট করতে হলে সবাইকে তা করতে হবে। দরকার হলে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহারই করব না। আমরা শপথ নেব দিনের বেলায় কেউ বিদ্যুৎ ব্যবহার করব না।”
প্রধানমন্ত্রীর এই জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, “জ্বালানির সংকট মোকাবিলায় বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই একটি প্রতিনিধিদল রপ্তানিকারক কয়েকটি দেশের সঙ্গে ডেফার্ড পেমেন্টের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহের আলোচনা করবে। কয়েকটা জায়গা থেকে খুব কম দামে এলএনজি কেনার জন্য অফার পেয়েছি। ১০ বা ১২ ডলারে দেবে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি। কীভাবে তারা দেবে তা জানি না। এছাড়া ডিসেম্বর-জানুয়ারির দিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আসবে। অন্যদিকে ক্রাশ প্রোগ্রামের আওতায় হাজার মেগাওয়াটের সোলার প্যানেল স্থাপন করা হবে। তখন যে পরিমাণ গ্যাস সাশ্রয় হবে, সেটা শিল্পে সরবরাহ করা হবে।”
অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়েক সেন বলেন, “খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা আমাদের মৌলিক নিরাপত্তা। এ দুটি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে ইউরোপের মতো অবস্থা আমাদেরও হবে। স্পট মার্কেট অরিয়েন্টেড করে আপাতত দুই মাস সমাধান দিতে পারব। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এক বছরে শেষ হবে না। তাই সবাইকে সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নিতে হবে।”
এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একে আজাদ বলেন, “গ্যাস সংকটে গত দেড় মাসে রাতে কারখানা চালাতে পারিনি। সন্ধ্যার পরপরই বন্ধ করে দিতে হয়। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৩৮% ছিল তা এখন ৭.৫২% হ্রাস পেয়েছে। অন্য লাইন থেকে ৫% গ্যাস দিলেও আমরা কারখানায় রাতের শিফট শুরু করতে পারি। অন্যথায়, কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে, নইলে শ্রমিকদের বেতন কীভাবে দেব। আগামী ৬ মাস থেকে এক বছর এই অবস্থা থাকলে শিল্প কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা ভেবে দেখা দরকার।”
নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি আক্তার হোসেন অপূর্ব এ খাতকে বাঁচাতে ফার্নেস অয়েলের ওপর থেকে ৩৪% ভ্যাট অপসারণের দাবি জানান।
এফআইসিসিআই”র সহ-সভাপতি স্বপ্না ভৌমিক বলেন, “আমরা ২৭টি তৈরি পোশক কারখানা পরিদর্শন করেছি। প্রতিটি কারখানাই জ্বালানি সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেহেতু সব কিছুর দাম বাড়ছে, যথেষ্ট উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাস না পেলে এই খাতকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।”
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, “দেশে শিল্পের কোনো কাঁচামাল উৎপাদন হয় না। একমাত্র কাঁচামাল আছে গ্যাস। গ্যাসের ওপর নির্ভর করেই শিল্প গড়ে উঠেছে। এখন গ্যাস সংকটে টেক্সটাইল খাত নাজুক অবস্থায় আছে। সুতা-কাপড়ের উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। নোটিফিকেশন না দিতে পারার কারণে চুক্তি সত্ত্বেও এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না। যাদের ভুলে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, “শিল্পকারখানায় ৭-৮ ঘণ্টা গ্যাস-বিদ্যুৎ থাকছে না। তেলের দাম বাড়ানোর পর লোডশেডিং বেড়ে গেছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় শিল্পের গ্যাসের লাইন ও আবাসিকে ব্যবহারের গ্যাসের লাইন আলাদা করার বিষয়টি ভাবতে হবে। তাছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে ২৪ টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করা হচ্ছে, এর যৌক্তিকতা আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার যে রূপকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে তার বাস্তবায়ন করতে ৩০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লাগবে। এখন জ্বালানির অভাবে শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে সেই লক্ষ্য কীভাবে অর্জন করবো।”
Array