হাওলাদার হাসিব:
আজ আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য নিরসন দিবস। দারিদ্র্যের বক্ররেখায়, রাষ্ট্রের মারপ্যাঁচে সমাজের শ্রমিক শ্রেণি সবসময়ই অবহেলিত ও নিষ্পেষিত। মূলত এরাই অধিক হারে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠনের অভিপ্রায় নিয়ে ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ১৭ অক্টোবর ‘আন্তর্জাতিক দারিদ্র দূরীকরণ দিবস’ পালিত হয়।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের আহাজারি নিরসন করে সমৃদ্ধির বিশ্ব গড়তে ও বিশ্বের মানুষকে সচ্ছলতা ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই এ দিবসের সূচনা। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক দারিদ্র দূরীকরণ দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটির মূল লক্ষ্য অর্জন এবং বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। রিপোর্টের ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ এ খাতে ঈর্ষণীয় সফলতা লাভ করেছে গত দুই-তিন দশক ধরে। মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি)-এর চূড়ান্ত মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০০০-২০১০ সাল মেয়াদে গড়ে প্রতি বছর দারিদ্র্য কমেছে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ হারে, যা কিনা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতি বছর ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমানোর লক্ষ্যের চেয়ে বেশি। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে হ্রাস পেয়ে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছিল। ২০১০ সালে এটি ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে ১৯৯২ সালে এ হার ছিল ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও এখনো মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। করোনা মহামারির পরে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বর্তমানে সমাজের প্রতিটা শাখায় দৃশ্যমান। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে। দ্রব্যের দাম অবিশ্বাস্য ঊর্ধ্বগামী হওয়ায় এটা স্বাবলম্বী পরিবারের জন্য চালিয়ে নেওয়ার মতো হলেও দারিদ্র্য শ্রেণির জন্য এটা দুর্ভিক্ষরূপে এসে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশে শ্রমজীবী মানুষের পরিসংখ্যান বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ শ্রমজীবী মানুষ যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে অবদান রেখে যাচ্ছেন। সেটা প্রবাসে আয়ে হোক কিংবা শিল্প খাত বা অন্য যে কোনো কঠিন শ্রমে নিয়োজিত থেকে হোক। একজন শ্রমিক সে হোক না রিকশাওয়ালা, রিকশা চালিয়ে নিজে একা খান না। বরং এ সামান্য আয় দিয়ে সে আস্ত একটা পরিবার পরিচালনা করে থাকেন। তার এক দিনের আয়ের ওপর নির্ভর করে ঐ দিনের জীবনযাপন। তাদের এ স্বাভাবিক জীবনযাপনের পরিক্রমা ব্যর্থ হলে না খেয়ে থাকা লাগে, তা কি আমরা ভেবেছি? মানুষ যখন ক্ষুধার রাজ্যে থাকে তখন ক্ষুধাই হয়ে ওঠে তার জন্য ভয়ংকর মহামারি। দেশ অনুযায়ী দেশের মানুষের কৃষ্টি-কালচার কিংবা মানুষিকতার ভিন্নতা থাকে। আমাদের দেশের সরকার কোনো দুর্যোগে পড়লে স্বাভাবিকভাবে আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিয়ে উলটো সরকারের ওপর চাপ বাড়িয়ে দেই। এটা বর্তমান বা বিগত সব সরকারের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। দেশের এ অর্থনৈতিক সংকট কালে যখন বাজারে স্বাভাবিকের চেয়ে হুহু করে বাড়ছে সবকিছুর দাম, তখন দেশের সিন্ডিকেট পরিচালনা করা কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এ সুযোগটা নিজস্ব পূর্ণিমার রাতের মতো লুফে নিচ্ছেন। তাতে দেশে সংকট আরো দানবীয় আকার ধারণ করছে প্রতিনিয়ত।
এগুলো মূলত নৈতিকতার অবক্ষয়জনিত রোগ ছাড়া আর কিছুই নয়। এর ফলে আমরা এমডিজির যে লক্ষমাত্রায় পৌঁছাতে পেরেছি বলে সফলতার ঢেকুর গিলছি, এরকম বাজারসংকট চলতে থাকলে দারিদ্র্যের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে আগের চেয়েও ভয়ানক হতে পারে। দরিদ্রতা কমিয়ে আনতে চাইলে আগে তাদের খাবার কিংবা যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিষয়ের নিশ্চয়তা দিতে হবে। ভাতের অভাবে কেউ যাতে করে কবির এ কবিতার মতো আর্তনাদ না করে:—‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/ পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’।
পৃথিবীর বহু কোণে বহু সংস্থা দারিদ্র্য নিরসন নিয়ে কাজ করছে। আদতেই এর কোনো ফলাফল এখনো দৃশ্যমান কি না—তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশেও কিছু সংস্থা কাজ করছে বহু আগ থেকেই, মূলত এটা কোনো সংস্থার একক কাজ নয়, এখানে সবার সম্পৃক্ততা থাকা জরুরি।
বর্তমান যে দুর্যোগ চলছে তা মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে দলমত নির্বিশেষে সরকারকে সাহায্য করা উচিত। যাতে এ মানুষগুলো ভালো থাকে। কারণ এরা ভালো থাকলে ভালো থাকবে বাংলাদেশ। পৃথিবীর তাবৎ রিপোর্ট একই সুরে বলে, ‘প্রতি বছর মিলয়ন মানুষ ক্ষুধা নিয়ে মারা যায়’। এরা সবাই দরিদ্র। তাই আমরা আন্তর্জাতিক মোড়ল সংস্থার কাছে এ দিনে মানবিক আবেদন করবো, তাদের অন্তত দুমুঠো খাবারের নিশ্চয়তা দিন।
লেখক :শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
Array