অনলাইন ডেস্ক:
সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি। এদেশের বুক চিরে বয়ে চলা হাজারও নদনদী, খাল-বিল-ঝিল, হাওড়-বাওড়, হ্রদ ও ছোটবড় জলাশয় প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়, যা দেশি-বিদেশি হাজারও প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসু মানুষকে আকৃষ্ট করবে নিশ্চিতভাবেই। বাংলার নয়নাভিরাম রূপপ্রকৃতি বর্ণনার আলোকচ্ছটা প্রতিফলিত হয়েছে ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং, ইবনে বতুতার মতো বিখ্যাত সব পর্যটকদের লেখনীর মাধ্যমে। তাদের লেখায় প্রকাশ পেয়েছে প্রাচীন বাংলায় জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদনদীর বর্ণনা এবং নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার নানা কথোপকথন।
মানুষের মনে নির্মল প্রশান্তি এনে দিতে, অবসর সময়ের আমুদ-উল্লাস ও সুস্থ বিনোদনের চাহিদা পূরণে পর্যটন খাতগুলো অপরিসীম ভূমিকা পালন করে থাকে। বলা বাহুল্য, বর্তমান বিশ্বে পর্যটন একটি শিল্প, যার রয়েছে অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ বহুমাত্রিক শৈল্পিক সম্ভাবনা। আর পর্যটনশিল্পের সেই সম্ভাবনার অধিক্ষেত্রে নতুন মাত্রা এনে দিতে পারে রিভার ট্যুরিজম বা নৌ-পর্যটন। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই অবারিত দানকে কাজে লাগিয়ে রিভার ট্যুরিজম বা নৌ-পর্যটনের অমিত সম্ভাবনার ক্ষেত্র উন্মোচন করা সম্ভব। ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের উন্নত দেশগুলো তাদের বড় বড় শহরগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজতর করতে নদী বা খালের পানির সংযোগ স্থাপন করে শহরের ভেতরে নিয়ে এসেছে, যার মাধ্যমে সেসব দেশ পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ হচ্ছে।
এক সময় আমাদের দেশের বড় বড় শহরগুলোতে ছোটবড় খাল এবং নদীর অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অতি নগরায়ণের প্রভাবে হারিয়ে গেছে সেইসব প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো; যেগুলো এখন নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় এবং পর্যটনের দারুণ সম্ভাবনার ক্ষেত্র হতে পারত। তবে, আশার কথা হচ্ছে আমাদের দেশে এখনো যে পরিমাণ নদীনালা, খাল-বিল-ঝিল, পুকুর-দীঘি ও হ্রদ রয়েছে তা আমাদের নৌ-পর্যটন বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে। বাংলাদেশের কাপ্তাই, রাঙামাটি, সুনামগঞ্জ, রাজশাহী, ভৈরব, বাগেরহাট, খুলনা, বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি এবং পটুয়াখালী অঞ্চলে নৌ-পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার পর্যাপ্ত সুযোগ এবং সম্ভাবনা রয়েছে। এসব অঞ্চলের নৌ-পর্যটনশিল্প বিকাশের জন্য প্রয়োজন নদীর নাব্যতা রক্ষা, নদী-ভ্রমণের উপযোগী আরামদায়ক নৌযানের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং আধুনিক সুবিধাসংবলিত জাহাজ ও স্টিমারের মানসম্মত আনয়ন।
এর ফলে পর্যটকরা খুব সহজেই স্বাচ্ছন্দ্যে রাঙামাটি, কাপ্তাই, চাঁদপুর এবং বরিশালের মতো অঞ্চলের প্রকৃতির অপূর্ব শোভা এবং আরামদায়ক ক্লান্তিহীন ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবে। এতে করে পর্যটন স্পটগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব হবে। রিভার ট্যুরিজমের এই বিকাশ সম্ভব হলে উক্ত অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে। এছাড়াও আমাদের আবহমান গ্রাম-বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সারা বিশ্বে পরিচিতি দানে অবদান রাখতে পারবে। রিভার ট্যুরিজমের প্রসারের মাধ্যমে নদীতীরবর্তী মানুষের জীবনের মর্মার্থ আবিষ্কার করাও সম্ভব হবে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, যার কারণে সড়কপথ এবং রেলপথে প্রতিনিয়ত ভোগান্তি লেগেই থাকে। সেদিক থেকে নৌভ্রমণ অনেক আরামদায়ক এবং ভোগান্তির পরিমাণও তুলনামূলক কম। তাই নৌ-পর্যটনের বিকাশ করা গেলে যোগাযোগ ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা সম্ভব। উল্লেখ্য যে, নৌ-পর্যটনের বিকাশ সাধন এবং যোগাযোগকে সহজতর করতে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা শহরকে অবেষ্টন করে থাকা নদনদীগুলোতে ওয়াটার বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু এসব উদ্যোগকে সীমাবদ্ধ না রেখে নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর ও রাঙামাটির মতো অঞ্চলগুলোতে বিস্তৃতি ঘটানো গেলে দেশের নৌ-পর্যটনশিল্পের সমৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
আমাদের সবাইকে অনুধাবন করতে হবে, পর্যটন একটি শিল্প। তাই এটিকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে এই শিল্পের উন্নয়নে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রিভার ট্যুরিজম বিকাশের প্রয়োজনে আমাদের নদীগুলোকে ড্রেজিংয়ের আওতায় এনে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ অতীব প্রয়োজনীয়। একবিংশ শতাব্দীর ভুবনায়নের যুগে বিশ্বায়নের ইতিবাচকতাকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন শিল্পের বাজার সৃষ্টি, দেশের টেকসই উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা নিশ্চিতে নৌ-পর্যটনশিল্প হতে পারে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
Array