জান্নাতুল ফেরদৌস, ক্যাম্পাস থেকে:
ঢাকা শহরের প্রাণ কেন্দ্রে প্রায় ২৫৬ একর জায়গা নিয়ে গঠিত দেশের অন্যতম প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
যদিও ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এর আয়তন ছিল প্রায় ৬০০ একর, কালের আবর্তনে যা কমে এসেছে। বিস্তর এ এলাকার আনাচে কানাচে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা, ভাস্কর্য, রাস্তা এবং চত্বর। ঢাবি ক্যাম্পাসের বাঁকে বাঁকে থাকা কিছু চত্বরগুলোর সঙ্গে একদিকে যেমন মিশে রয়েছে অনেক স্মৃতিকথা তেমনি ক্যাম্পাসের ভৌগলিক পরিচিতি পেতেও এগুলো সহায়ক।
বাংলা একাডেমির অভিধান অনুযায়ী চত্বর শব্দের অর্থ চাতাল, চবুতর, প্রাঙ্গণ, উঠান, আঙিনা, রঙ্গভূমি, যজ্ঞভূমি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা চত্বরগুলোর মধ্যে রয়েছে- সবুজ চত্বর, মিলন চত্বর, পায়রা চত্বর, ভিসি চত্বর, স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য চত্বর, ডাস, সামাজিক বিজ্ঞান চত্বর, দোয়েল চত্বর, মল চত্বর এবং হাকিম চত্বর।
সবুজ চত্বর: শিক্ষক-ছাত্র কেন্দ্র বা টিএসসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাধিক পরিচিত স্থান। এর অভ্যন্তরে প্রবেশ পথ হতে ডান দিকে যে ঘাস যুক্ত খোলা স্থানটি দেখা যায় সেটি সবুজ চত্বর নামে পরিচিত। এই সবুজ চত্বরে প্রতিনিয়ত পদার্পণ ঘটে শত শত শিক্ষার্থীদের। গোল হয়ে বসে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে আড্ডা এবং গান। বিভিন্ন কনসার্ট এবং অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে এই সবুজ চত্বরে।
মিলন চত্বর: এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য হতে শাহবাগ রোড অভিমুখে এবং নীলক্ষেত রোডের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনের সময় তৎকালীন সরকারের সমর্থিত সন্ত্রাসীদের গুলিতে ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত হন। এই শোকাবহ ঘটনার স্মরণে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর শহীদ ডা. মিলন দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। ডা. মিলনের মধ্য দিয়ে তখনকার স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চারিত হয় এবং অল্প কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।
পায়রা চত্বর: দেখতে কোনো ভাস্কর্য মনে হলেও এটিকে চত্বর হিসেবেই সবাই জানে। এর অবস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র কেন্দ্র বা টিএসসি এর প্রবেশ পথ হতে উত্তর দিকে অবস্থিত। চত্বরটিতে অবস্থিত ভাস্কর্যটিকে শান্তির পায়রা বলা হয়। একে শান্তির এবং সংহতির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
ভিসি চত্বর: ভিসি চত্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি স্থান। এটি নীলক্ষেত রোড অভিমুখে দক্ষিণ পাশে ফুলার রোড এবং নীলক্ষেত রোড এর সংযোগ স্থলে ভিসি’র বাসভনের সম্মুখে অবস্থিত। এখানে রয়েছে বিখ্যাত ফলক ‘স্মৃতি চিরন্তন’। এর নামফলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪ জন শহীদের নাম রয়েছে। স্থাপনাটির প্রাথমিক নকশা করেছেন স্থপতি আব্দুল মোহায়মেন ও মশিউদ্দিন শাকের। এছাড়াও একটি ফোয়ারা রয়েছে।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য চত্বর: স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যটি বাঙালী জাতির গৌরব মন্ডিত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে প্রতিনিধিত্বকারী সর্ববৃহৎ ভাস্কর্য। এর ভাস্কর শামীম শিকদার। এই ভাস্কর্যটিকে ঘিরেই হলো স্বাধীনতা সংগ্রাম চত্বর যার অবস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফুলার রোডে সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল ও বুয়েট সংলগ্ন সড়ক দ্বীপে।মূল ভাস্কর্য স্বাধীনতা সংগ্রামকে ঘিরে রয়েছে দেশ-বিদেশের শতাধিক কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, বিপ্লবী, রাজনৈতিক, বিজ্ঞানীর আবক্ষ মোট ১১৬টি ভাস্কর্য।সবগুলোই শামীম শিকদারের গড়া। কারো কারো ভাস্কর্য অপূর্ব ভঙ্গিমায় উপস্থাপিত।
ডাস চত্বর: এটি মূলত ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র বা টিএসসি সড়কদ্বীপে অবস্থিত একটি স্ন্যাকস কর্ণারকে কেন্দ্র করে গঠিত। এখানে বিখ্যাত ভাস্কর্য স্বোপার্জিত স্বাধীনতা অবস্থিত। এই ভাস্কর্যের পুরো গাজুড়ে রয়েছে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচারের একটি খণ্ড চিত্র। চৌকো বেদির ওপর মূল ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। উপরে বামে আছে মুক্তিযোদ্ধা কৃষক আর ডানে অস্ত্র হাতে দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাঝখানে অস্ত্র হাতে নারী ও পুরুষ যোদ্ধারা উড়িয়েছে বিজয় নিশান। কিন্তু পতাকা ওড়ানোর জন্য বাঙালি যে রক্ত দিয়েছে, সয়েছে নির্যাতন, তার কটি খণ্ডচিত্র বেদির চারপাশে চিত্রায়িত। এ ভাস্কর্য বেদির বাম পাশে আছে ছাত্র-জনতার ওপর অত্যাচারের নির্মম চেহারা। এই ডাচ চত্বরের চারপাশ সর্বদা মানুষের এবং হকার দের আনাগোনার মুখরিত থাকে। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ফুল বিক্রয়কারীদের।
সামাজিক বিজ্ঞান চত্বর: চারদিকে সবুজে ঘেরা গাছপালা, ছোট ছোট বসার টুল, ঝড়না ঘিরে গোল চত্বর আর কৃত্রিম বৃষ্টির আয়োজন এরই মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান চত্বরটিকে করে তুলেছে আকর্ষণীয়। এর অবস্থান সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সম্মুখে। লাইব্রেরির সামনে থেকে কলাভবনমুখী এবং মধুর ক্যান্টিন থেকে সেন্ট্রাল মসজিদ সংলগ্ন রাস্তার পাশে রয়েছে বসার বিভিন্ন স্থান। চত্বরের অন্যতম আকর্ষণ ঝরনা। সন্ধ্যায় এতে জ্বলে ওঠে আলো। ক্ষণে ক্ষণে আলোর রঙ পরিবর্তন ঝরনার পরিবেশকে দিয়েছে মোহনীয় রূপ। ঝরনার পাশে যাওয়ার জন্য আছে ছোট্ট সেতু। এর নিচে ছোট ছোট পাথরের সারি। এছাড়াও এখানে রয়েছে একটি স্ন্যাকস কর্ণার যেখানে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় মুখরোচক খাবার পাওয়া যায়।
দোয়েল চত্বর: দোয়েল চত্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভেতরে কার্জন হলের সামনে অবস্থিত। বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েলের একটি স্মারক ভাস্কর্য। এর স্থপতি হলেন আজিজুল জলিল পাশা। এটি বাংলাদেশের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক যা দেশের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে। শাহবাগে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে দোয়েল চত্বর। লোক ও কারুশিল্পীরা দোয়েল চত্বর এলাকায় প্রায় ৪০টি মৃৎশিল্পের দোকানসহ মোট ৫০টি বাঁশ, বেত ও কাঠের হস্তশিল্পের দোকানে নানা বাহারি পণ্যের পসরা নিয়ে বসে।
মল চত্বর: সবুজে ঘেরা বিস্তীর্ণ স্থান মল চত্বর কে চেনে না বা কখনো যায়নি এ কথা ঢাবির কোনো শিক্ষার্থীই হয়তো বলতে পারবে না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যেখানে শিক্ষার্থীদের গল্প, গান এবং আড্ডায় মুখরিত থাকে এছাড়াও এর রাস্তা দিয়ে ঢাবির শিক্ষার্থী এবং কর্মচারীদের জন্য চলাচল করা পরিবহণ গুলো যাওয়া আসা করে। এই মল চত্বরটির অবস্থান কলাভবন আর রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের মাঝামাঝি জায়গায়। এর নামকরণ করা হয় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সাবেক ফরাসী সংস্কৃতি মন্ত্রী আন্দ্রে মারলোর সম্মানার্থে।
হাকিম চত্বর: ঢাবি ক্যাম্পাসের অন্যতম পরিচিত চত্বর গুলোর মধ্যে একটি হলো হাকিম চত্বর। ১৯৬৭ সালের দিকে বাবার হাত ধরে দোহার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাড়ি জমান হাকিম। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ঘেঁষা সবুজ চত্বরটি তখন জঙ্গলে ভরা। আজকের মতো এত মনোরম তথা পরিপাটি সুন্দর পরিবেশ ছিল না। আম গাছের নিচে বসে চা বিক্রি করতেন হাকিম। তখন থেকে ওই এলাকাকে হাকিম চত্বর বলা হতো। কিন্তু হাকিম চত্বর প্রসিদ্ধি পায় হাকিম মারা যাওয়ার পর। বর্তমানে হাকিম চত্বরে খিচুড়ি, ফ্রাইড রাইস, ব্রেড টোস্ট, হালিম ইত্যাদি খাবার পাওয়া যায়। দুপুরে ক্লাসের ফাঁকে আড্ডায় যেখানে শিক্ষার্থীরা গাছের শীতল ছায়াতলে বসে তাদের লাঞ্চ সেরে নেয়।
উল্লেখিত চত্বরগুলো ছাড়াও ঢাবির শিক্ষার্থীরা মজার ছলে আরও কিছু স্থানকে বিভিন্ন চত্বর নামে ডেকে থাকে। যেমন ভাবনা চত্বর, তাজমহল চত্বর, প্রেম চত্বর, বিড়ি চত্বরসহ নানান চত্বর।
Array