স্টাফ রিপোর্টারঃ
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের ৭২ কিলোমিটার অংশ দুই লেনে উন্নীত করার কাজ ছয় বছরেও শেষ হয়নি। এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে দুবার। প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হয়েছেন সাতবার। আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত এই প্রকল্পের কাজ চলছে।
গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনে ট্রেনে যাতায়াতে অন্তত পৌনে এক ঘণ্টা সময় কমবে বলে আশাবাদী প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। যেমন সুবর্ণ এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ছাড়ে সকাল সাতটায়, রেলের হিসাবে ঢাকা পৌঁছায় দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে। অর্থাৎ সময় লাগে ৫ ঘণ্টা ২০ মিনিট। আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত দুই লেনের রেললাইনের কাজ শেষ হলে তখন সাড়ে চার থেকে পৌনে পাঁচ ঘণ্টায় যাওয়া সম্ভব হবে।
৬ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার জন্য মহামারি করোনা পরিস্থিতিকে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। জমি অধিগ্রহণ ও দীর্ঘদিন ধরে সেখানে বসবাস করা লোকজনকে পুনর্বাসন নিয়েও জটিলতা ছিল।
পরে তার সমাধান হয়। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকা থেকে চারটি খাদ্যগুদাম স্থানান্তর করতেও সময় লেগেছে। এখন নির্মাণকাজ আগামী বছরের জুনে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়া প্রসঙ্গে বর্তমান প্রকল্প পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কোভিড পরিস্থিতিতে নির্মাণকাজ প্রত্যাশিত গতিতে করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন পুরোদমে কাজ চলছে। সেতু ও কালভার্টের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। লাকসাম থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। আর বাকি অংশেও কাজ চলমান রয়েছে।
তবে সীমান্তবর্তী এলাকায় রেললাইন নির্মাণ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে জানান মো. শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, কসবা ও সালদা নদী এলাকায় সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে রেললাইন নির্মাণ নিয়ে আপত্তি দিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। আরও কিছু প্রকল্পে এ ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। এখন সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তা যৌথভাবে সমাধানের চেষ্টা চলছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প ২০১৪ সালের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এর কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। মেয়াদ ধরা হয় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। তবে ওই সময় কাজ শেষ হয়নি। এরপর ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৮৪ শতাংশ।
চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন, ম্যাক্স ও তমা কনস্ট্রাকশন যৌথভাবে এই প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে। প্রকল্পের কাজ সর্বশেষ নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে কি না জানতে ম্যাক্সের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ইয়াহিয়া মোকারমের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হয়। তবে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন ৩২০ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার দীর্ঘ। আগে থেকে ১১৮ কিলোমিটার পর্যন্ত দুই লেনের ছিল। এরপর তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে লাকসাম-চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ৬১ কিলোমিটার, টঙ্গী-ভৈরব বাজার পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার এবং দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৬ কিলোমিটার অংশ দুই লেনে উন্নীত করা হয়েছিল। এখন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার অংশ মিশ্রগেজের (মিটার ও ব্রডগেজ) দুই লেন নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন পুরোটাই দুই লেন হয়ে যাবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, আখাউড়া থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে এখনো স্টেশন ও লাইন নির্মাণকাজ অব্যাহত রয়েছে। তবে সীমান্তের শূন্যরেখার (নো ম্যানস ল্যান্ড) ১৫০ গজের মধ্যে হওয়ায় কসবা রেলস্টেশনের নির্মাণকাজ থমকে আছে। কুমিল্লা থেকে লাকসাম পর্যন্ত রেললাইনের কাজ শেষ হয়েছে। কুমিল্লা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার অংশের নির্মাণকাজ চলছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী। পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় মো. লিয়াকত আলীকে। তৃতীয় প্রকল্প পরিচালক মোজাম্মেল হক। প্রকল্পটির চতুর্থ প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার (ডি এন মজুমদার)। এরপর প্রকল্পটির পঞ্চম প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল মো. আরিফুজ্জামানকে। কিছুদিন কাজ করার পর আবার প্রকল্প পরিচালকের পরিবর্তন হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রমজান আলীকে। সর্বশেষ এই প্রকল্পের সপ্তম প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন মো. শহীদুল ইসলাম।
একটি প্রকল্পে সাতজন পরিচালক পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রামে বাধাহীনভাবে ট্রেন চলাচলের জন্য প্রকল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে বারবার প্রকল্প পরিচালকের পরিবর্তন হলে উন্নয়নকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কেননা পরিচালক প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকেন। নেতা পাল্টে গেলে পরবর্তী ধাপে দিকনির্দেশনা কার্যকরে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সীমান্তকেন্দ্রিক জটিলতা নিরসনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।